চোখে অন্ধকার দেখছেন সুনামগঞ্জের খামারিরা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মে ২০২২, ১১:৫৮ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
পাহাড়ি ঢল ও ভারি বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় সুনামগঞ্জের মৎস্য খামারিরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জেলার দেড় হাজার পুকুরের প্রায় ১০ কোটি টাকার বিভিন্ন জাতের মাছ ভেসে গেছে বানের পানিতে। এতে পথে বসার উপক্রম খামারিরা। ব্যাংক ঋণ ও ধার-দেনা করে আনা বিরাট অঙ্কের টাকা পরিশোধ নিয়ে এখন চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। চোখে অন্ধকার দেখছেন।
২০১৭ সালে জেলার সফল মৎস্য খামারি হিসাবে পুরস্কার পেয়েছিলেন দোয়ারাবাজার উপজেলার ‘তাহসিন ফিশারিজ’র স্বত্বাধিকারী অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক মো. নূরুল ইসলাম। প্রায় ২০ একর জায়গায় তার মৎস্য খামার। ২০২০ সালে পাহাড়ি ঢলে তার খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুই বছরের মাথায় আবারও বন্যার ছোবলে পথে বসার জোগাড়। নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এবারের বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল ভাসিয়ে নিয়ে গেছে প্রায় ২০ লাখ টাকার বিভিন্ন জাতের বিক্রয়যোগ্য মাছ। এর মধ্যে ছিল-তেলাপিয়া, রুই, কার্ফু, মৃগেল। একদিকে ব্যাংক ও ডিলারদের দেনা, অন্যদিকে পুকুর নেই মাছ-কী করব কিছু ভেবে উঠতে পারছি না।’
একই উপজেলার আরেক সফল মৎস্য খামারি আলীপুর গ্রামের আব্দুর রহিম বলেন, খাসিয়ামারা নদীর তীর উপচে ভেসে যায় আমার নয়টি পুকুরে চাষ করা মাছ। গত বছর ১০২ বিঘা জমির ওপর নয়টি পুকুরে রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়ার লাখো পোনা ছেড়েছিলাম। প্রায় ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। টেংরাটিলা গ্রামের মাছচাষি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ১৬ একর জমি নিয়ে পাঁচটি পুকুর রয়েছে। বন্যায় প্রায় ৪০ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে।’
আলীপুর গ্রামের দ্বীন ইসলাম জানান, এছাড়াও সিরাজ মিয়া, হাবিবুর রহমান, সোহেল আহমদ, আসক আলী, শের মাহমুদসহ দোয়ারাবাজার উপজেলার ছোট-বড় চার শতাধিক মাছ চাষি এবারের বন্যায় যারপরনাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রায় তিন কোটি টাকার মাছ বানের পানিতে ভেসে গেছে। পুঁজি হারিয়ে সবাই এখন দিশেহারা।
দোয়ারার মাছ চাষিরা জানান, ২০২০-এর বন্যায় এদের অনেকের পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সারা বছর ঋণ ও ধারদেনা করে মাছের চাষ করতে হয়। তা ছাড়া এখন সহজে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া যায় না, ডিলাররাও বাকিতে মাছের খাদ্য দিতে চান না। এই দুঃসময়ে সরকার যদি মাছ চাষিদের পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে দেউলিয়া হয়ে এলাকা ছাড়তে হবে।
টেংরাটিলা বাজারের মাছের খাদ্য ও ওষুধ বিক্রেতা বজলুল মামুন বলেন, খামারিদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। শুধু দোয়ারাবাজার নয়, সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, শান্তিগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর ও শাল্লা উপজেলার কয়েকশ মাছের খামারির স্বপ্ন ভেঙেছে এবারের বন্যায়। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার রঙ্গারচর ইউনিয়নের চানপুর গ্রামে ১০ একর জায়গার ওপর ‘মেসার্স মোমিন ফিশারিজ’। ৯টি পুকুরের বিভিন্ন জাতের প্রায় ৩০ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আব্দুল আলিম। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক ঋণ ও ডিলারদের দেনা নিয়ে মারাত্মক বিপাকে রয়েছি।’
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার নর্থ-ইস্ট অ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী মাহবুব আশরাফ তপু শহরতলির গুজাউরা এলাকায় ১৬টি পুকুরে কোটি টাকার মাছ চাষ করেছিলেন। ভালো দাম পাওয়ার আশায় অধিকাংশ মাছ খামারেই ছিল। কিন্তু আকস্মিক বন্যায় অধিকাংশ মাছই ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সুনামগঞ্জ শহরতলির ইব্রাহিমপুরের মুসলিম উদ্দিন ১০ একর জমির ৯টি পুকুরে মাছ চাষ করেছিলেন। তিনি বলেন, বন্যায় আমার ‘ইব্রাহিমপুর মডার্ন অ্যাগ্রোফার্ম’র প্রায় ২৫ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। ব্যাংক ঋণ, ফিডের দেনা সবকিছু নিয়ে চরম বিপদে আছি।
মনোহরপুর গ্রামের বড় মাছ চাষি বাবলু মিয়ারও একই অবস্থা। এ ছাড়া রঙ্গারচর, হারিনাপাটি, জাহাঙ্গীরনগর, কুরবাননগর, গৌরারং, লক্ষণশ্রী, মোল্লাপাড়া প্রভৃতি ইউনিয়নের বড়, মাঝারি ও ছোট শতাধিক মৎস্য চাষি সাম্প্রতিক বন্যায় মাছ চাষ করে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
ছাতক উপজেলার মাছ চাষি ইউপি সদস্য সিরাজ মিয়া বলেন, এবারের বন্যায় জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ছাতকের মাছ চাষিরা। ছাতকে বাণিজ্যকভাবে যারা মাছ চাষ করেন তাদের কারও পুকুরে মাছ নেই। প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার মাছ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। মৎস্য খামার করে এরকমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সুনামগঞ্জের পাঁচ উপজেলার প্রায় দেড় হাজার ছোট-বড়-মাঝারি মৎস্য খামারি।
সুনামগঞ্জ সদরের বৃহৎ মৎস্য খাদ্য ব্যবসায়ী ‘সাদাফ পোলট্রি প্রডাক্ট’র স্বত্বাধিকারী জুবেদ আহমেদ মনজু বলেন, ‘২০২০ বন্যায় সুনামগঞ্জের মৎস্য চাষিরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন, মাঝখানে একবছর যেতে না যেতেই আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মৎস্য খাত। জেলার মৎস্য খামারিদের আমরা যারা মাছের খাদ্য জোগান দেই আমরাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছি। প্রতিটি খামারির কাছে আমাদের লাখ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। তারা যদি ব্যবসায় দাঁড়াতে না পারেন তাহলে তাদের সঙ্গে আমাদেরকেও রাস্তায় নামতে হবে।’
সুনামগঞ্জ হাওড় বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, ‘ছাতক, দোয়ারাবাজার ও সদর উপজেলার মাছ চাষিরা এবারের বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমাদের জরিপ অনুযায়ী কমপক্ষে ১০ কোটি টাকার মাছ বানের জলে ভেসে গেছে। মৎস্য অফিসের কাছে সবার তথ্য নেই। অনেক ছোট ও মাঝারি খামারিদের হিসাব সরকারি খাতায় থাকে না। তিনি বলেন, সুনামগঞ্জের মৎস্য খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রণোদনা ও সরকারি সহায়তা দিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের বাঁচিয়ে না রাখলে আগামীতে মৎস্য খাতে কেউ বিনিয়োগ করতে চাইবে না।’
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল মণ্ডল বলেন, ‘সুনামগঞ্জের পাঁচ উপজেলার মৎস্য খামারিরা এবারের বন্যায় বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এর মধ্যে ছাতক-দোয়ারার মৎস্য চাষিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমাদের জরিপ অনুযায়ী এ পর্যন্ত জেলায় ১ হাজার ৪৬৮টি পুকুরের মাছ বন্যায় ভেসে গেছে। এতে প্রায় ৫ কোটি ২ লাখ ৮১ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে পাঠিয়েছি। মাছ চাষিরা যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন সেজন্য পরামর্শ দিচ্ছি। সরকারি প্রণোদনার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে যা যা সহযোগিতা দেওয়া দরকার আমরা দেব। পাশাপাশি তাদের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।’সুত্র-যুগান্তর