পেটের সন্তান পরিচয় দেয় না, ঈদ ফিরিয়ে দিয়েছে আশ্রম
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ মে ২০২২, ৭:০৪ অপরাহ্ণ
রাবেয়া বেগম (৭৫)। জন্মস্থান নগরীর ডেমরায়। সড়ক দুর্ঘটনায় দুটো পা ভেঙে পড়েছিলেন সড়কে। এর পরে শরীরে পোকা-মাকড়ের বাসা। মাটি খেয়ে ফেলেছিল শরীরের বিভিন্ন অংশ। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছিলেন তিনি। ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিলেন। কিছু শিক্ষার্থীর উদ্যোগে রাবেয়া বেগমকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে। এর পরে খবর পেয়ে মানবিক ডাকে সাড়া দিতে ছুটে যায় চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের কর্মীরা।
এই আশ্রমের কর্মীদের নিরলস সেবায় এরই মধ্যে বৃদ্ধা রাবেয়া অনেকটা সুস্থ। প্রায় চার বছর এই আশ্রমে তিনি বসবাস করছেন। সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ-খবর প্রকাশ করলেও পেটের সন্তানেরা তার কোনো খোঁজ-খবর রাখে না।
শুধু রাবেয়া নন, তার মতো পরিবারহীন, অজ্ঞাত, অসহায় ও রাস্তায় পড়ে থাকা তিন সহস্রাধিক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও শিশু এখন পর্যন্ত সেবা পেয়েছে। এছাড়া বর্তমানে ১৩৫ জন বৃদ্ধ ও ৩০ জন শিশু এখানে রয়েছে। এদের কেউ খবরও রাখে না। রাবেয়া বেগমের ছেলেরা অনেক প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বোঝা মনে করে মায়ের কোনো খোঁজ-খবর রাখেন না তারা। রাবেয়া বেগমও বর্তমানে ছেলেদের পরিচয়ও কারোর কাছে দিতে চান না।
ঈদের দিন মঙ্গলবার (৩ মে) চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি পরিবারহীন, অজ্ঞাত, অসহায় ও রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষের জন্য ঈদে বিশেষ আয়োজন করেছে। সবার শরীরে ঈদের নতুন পোশাক। খাবার মেন্যুতে এসেছে বৈচিত্র্য। সেমাই, দই, মিষ্টি, পোলাও, মাংস ও ভাত।
রাবেয়া বেগম বলেন, সকালে সেমাই খেয়েছি। নতুন পোশাক পরেছি। ছেলেরা আমার কোনো খোঁজ-খবর রাখে না; ভাত-কাপড় দেওয়ার ভয়ে। মিল্টনই (মিল্টন সমাদ্দার ২০১৪ সালের ২১ অক্টোবর বৃদ্ধাশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন) আমার ছেলে। মিল্টন ওষুধ, খাবার, কাপড়-চোপড় সবকিছু দেয়।
আরেক হতভাগিনী রেনু বেগম। বাড়ি ফরিদপুর সদরে। দীর্ঘ পাঁচ বছর আগে তার পা ভেঙে যায়। স্বামী তাকে চিকিৎসার নামে ঢাকায় ফেলে পালিয়ে যায়। এর পরে আর কেউ খোঁজ রাখেনি রেনু বেগমের।
রেনু বেগম বলেন, আশ্রমে ভালো আছি। ঈদে নতুন জামা কাপড় পেয়েছি। সেমাই ও মাংস ভাত খেয়েছি। কষ্ট একটাই পরিবারের কেউ খোঁজ-খবর রাখে না।
আরেক হতভাগা বৃদ্ধ মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী টিপু। একটা প্রথম সারির ফোন কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। এর পরে বৃদ্ধ বয়সে সড়কে পড়ে গেলে কেউ খোঁজ রাখেনি। তার জন্মস্থান ফরিদপুর সদরে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ সেলিম। জন্মস্থান চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া। ২০১২ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসরে যান। এর পরে ২০১৪ সালে স্ত্রী মারা যায়। কয়েকদিন পরে প্যারালাইসড হয়ে যান সেলিম। চিকিৎসার জন্য বিশ্বাস করে প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকা দুই মেয়ের হাতে তুলে দেন। টাকা-পয়সা নিয়ে মেয়েরা তাকে রাস্তায় ফেলে দেয়।
এর পরে স্থানীয়রা বৃদ্ধকে সড়কের পাশে একটা পলিথিনের ঘর বানিয়ে দেন। এটা নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়, ‘প্রাথমিক শিক্ষকের ঠাঁই হয়েছে সড়কে’। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হওয়া এই খবর নজরে আসে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের কর্মীদের। এই আশ্রমের কর্মীদের নিরলস সেবায় এরই মধ্যে বৃদ্ধ অনেকটা সুস্থ। প্রায় পাঁচ বছর এই আশ্রমে বসবাস করছেন তিনি।
মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ঈদ উপলক্ষে নতুন জামা-কাপড় পরেছি। নিজের মেয়েরা খোঁজ-খবর রাখেনি। তারা খবর না নিলেও আমি ভালো আছি।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির আশ্রয়ে রয়েছেন মোট ১৬৫ জন বৃদ্ধ ও শিশু। এখন পর্যন্ত অজ্ঞাত শতাধিক ব্যক্তির দাফন-কাফন করেছে এই প্রতিষ্ঠান। মানবসেবায় প্রায় এক দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছেন এর প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন সমাদ্দার।
মিল্টন সমাদ্দার ২০১৪ সালের ২১ অক্টোবর বৃদ্ধাশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন। যিনি পেশায় একজন নার্স। ২০১৪ সালে রাজধানীর কল্যাণপুর পাইকপাড়ায় (বাড়ি-৪৬২, সড়ক-০৮ দক্ষিণ পাইপাড়া) ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ প্রতিষ্ঠা করেন। অবশ্য এটি প্রতিষ্ঠার পেছনে আছে একটি মানবিক গল্প।
একদিন কাজ সেরে বাসায় ফিরছিলেন মিল্টন সমদ্দার। রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধকে দুই পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। কোনো কিছু না ভেবেই মিল্টন তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন নিজের বাসায়। নিজ হাতে গোসল করালেন। পরিষ্কার জামা-কাপড় পরিয়ে খাওয়ালেন। পরিচয়হীন বৃদ্ধাকে পরম যত্নে মরণাপন্ন অবস্থা থেকে সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু অসহায় বৃদ্ধের যাওয়ার কোনো জায়গা না থাকায় তাকে আশ্রয় দিলেন মিল্টন। সেই থেকে শুরু। এখন প্রায় এক দশক হতে চললো। বর্তমানে এমন শতাধিক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও শিশুর আশ্রয় হয়েছে দেশের ব্যতিক্রমী এ প্রতিষ্ঠানে।
পরিবারহীন কুড়িয়ে পাওয়া শিশু এবং শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে গত ডিসেম্বরে এখানে চালু করা হয়েছে মাদরাসা শিক্ষা কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানটির আশ্রয়ে বর্তমানে ৩০ জন শিশু রয়েছে। এদের মধ্যে মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ শিশুরা শিক্ষার আওতায় এসেছে। শিশু রাতুল ও তায়্যেবা এরইমধ্যে শিখেছে বেশ কয়েকটি সুরা। চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের পাশাপাশি স্থানীয় শিশুরাও ধর্মীয় শিক্ষা পাচ্ছে।
কীভাবে চলে এই আশ্রম?
ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা দেশে বৃহৎ এই আশ্রমে প্রতি মাসে খরচ হয় ২৮ লাখ টাকা। পরিচালক মিল্টন সমাদ্দার জানান, তিনি ও তার স্ত্রী দু’জনেই পেশায় নার্স। এছাড়া ‘মিল্টন হোম কেয়ার প্রাইভেট লিঃ’ নামে তাদের একটি নার্সিং এজেন্সি আছে। যেখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সেবা দেওয়া হয়। প্রথমদিকে তাদের উপার্জিত অর্থ দিয়েই চলত আশ্রমটি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আশ্রমে অসহায় বৃদ্ধ ও শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে খরচও বেড়েছে কয়েকগুণ। তবে মানবিক এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন বহু মানুষ।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজ এবং প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন সমাদ্দারের ফেসবুক পেজ মিলে ৫০ লাখ ফলোয়ার ছাড়িয়েছে। এই ফেসবুক পেজের মাধ্যমেই দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অনেকেই সহযোগিতা করেন।
চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের ম্যানেজার মো. মিরাজ হোসেন বলেন, বর্তমানে আমাদের আশ্রমে মোট ১৬০ জন বৃদ্ধ ও শিশু রয়েছেন। এরা সবাই পরিচয়হীন। কেউ থাকলেও খোঁজ-খবর রাখে না। অনেক বৃদ্ধ সড়কে পড়েছিল শরিরে পোকা ও ঘা হয়ে গেছিল। আমরা এদের কুড়িয়ে এনেছি। অনেকে ডাস্টবিনেও পড়েছিল। তবে শিশুদের বিষয়গুলো আরও করুণ। প্রতিবন্ধী হওয়ায় শিশুদের নির্জনে ও ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়। আমরা এনে চিকিৎসা দিয়েছি।
মাসে কেমন খরচ হয়? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব মানুষকে ডাক্তার দেখানো, ওষুধ ও খাবার-কাপড় দিয়ে মাসে ২৮ লাখ টাকা খরচ হয়। অনেক মানুষ আমাদের কাছে সেবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন টাকা ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করেন ।
পরিচয়হীন মানুষদের ঈদের আয়জন কী ছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে মিরাজ বলেন, সবার জন্য নতুন পোশাক। এছাড়া সেমাই, মিষ্টি, মাংস, পোলাও এবং সাদা ভাতের ব্যবস্থা করেছি।