‘রঙাইর বিছরা’ ট্র্যাজেডি: তারিফের পর মারা গেল সুফিয়ানও
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৩০:১০,অপরাহ্ন ২৮ এপ্রিল ২০২২
কোনো আক্রোশ নেই। খেলা নিয়ে প্রতিযোগিতা। দুই গোলে হার। এটি সহ্য হয়নি অতর্কিত সশস্ত্র হামলা। ঝরে গেল দুটি তাজা প্রাণ। এমন ঘটনায় শোকাতুর সবাই। ঘটনা সিলেটের গোলাপগঞ্জের রনকেলী গ্রামে। ঐতিহ্যবাহী এলাকা রনকেলী। এমন গ্রামে হৃদয়বিদারক এই ঘটনায় শোকে স্তব্ধ সবাই। প্রায় আড়াই মাস আগের ঘটনা।
১৮ই ফেব্রুয়ারি বিকালে স্থানীয় ‘রঙাইর বিছরা’ মাঠ। রনকেলী ফ্রেন্ডস স্টারদের পক্ষ থেকে গ্রামভিত্তিক ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলা। এক দিকে রনকেলী নয়াগ্রাম, অপরদিকে রনকেলী রঙাই বিছরা গ্রাম। পাশাপাশি দুই গ্রাম। খেলা রঙাই বিছরা মাঠে। বিকালে খেলায় রঙাইর বিছরা থেকে দুই গোলে এগিয়ে যায় রনকেলী নয়াগ্রাম। এতে খেলায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। নয়াগ্রামের শাহনুর মাঠের বাইরে থেকে ব্রিফ দেয়া নিয়ে নড়ুপাড়া গ্রামের সোহাগের সঙ্গে তর্ক হয়। খেলা শেষে দেখিয়ে দেয়ার হুমকিও দেয় সোহাগ। কিন্তু খেলার শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে নিজের মাঠেই প্রতিপক্ষ নয়াগ্রামের খেলোয়াড় ও তাদের লোকজনের ওপর হামলা চালায়। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা, পরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপ। মাঠের বাইরে বসে খেলা দেখছিলো নয়াগ্রামের যুবক তারিফ আহমদ। স্বজনদের ওপর হামলার দৃশ্য দেখে এগিয়ে যান। হামলা থামাতে গিয়ে তিনিও হামলার শিকার হন। তারিফকে স্টেপিং করা হয়। এতে তারিফের দেহের বিভিন্ন স্থান রক্তাক্ত হয়। সঙ্গে আরও কয়েকজন। তাদের ঘটনার পর পরই সিলেটের নর্থইস্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পেশায় মেডিকেল এসিসটেন্স তারিফের শরীরে ছিল একাধিক আঘাতের চিহ্ন। রক্তক্ষরণ হয়েছে। ফলে ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতালে আনার পর পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ২২ বছর বয়সী তারিফ। গুরুতর আহত হয়েছিল আবু সুফিয়ান। বুকের পাঁজর, কিডনিসহ একাধিক স্থানে পেছন থেকে আঘাত করা হয়। স্বজনদের বাঁচাতে নিজেই এগিয়ে গিয়েছিল। জাপটে ধরে স্বজনদের রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি আবু সুফিয়ানের। টগবগে তরুণ আবু সুফিয়ান গুরুতর আহত হয়। প্রথমে সিলেটের নর্থইস্ট, এরপর ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। কিন্তু বুকের কাছের স্টেপিং গুরুতর। ঢাকার গ্রীনলাইন হাসপাতালে দুইবার অপারেশন করা হয়। কাজ হয়নি। প্রায় আড়াই মাস মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে গতকাল সকালে চিরতরে বিদায় নেয় আবু সুফিয়ানও। তারিফের মৃত্যুর শোক সইতে না সইতে আবু সুফিয়ানের মৃত্যুতে আরও কাতর হয়ে পড়েছেন এলাকার মানুষ। খেলার মাঠে খেলতে গিয়ে লাশ হয়ে ফেরার ঘটনা গোলাপগঞ্জে বিরল।
তবে- ঘটনার পর পরই পুলিশ আইনি উদ্যোগ গ্রহণ করে। মামলা দায়েরের আগেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে টুর্নামেন্ট পরিচালনা কমিটির নেতা আবিদুর রহমান, আতিকুর রহমান, এমান হোসেন ও আব্দুল সালামকে। তারা হামলাকারীদের স্বজনও। পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করে। কয়েকদিন আগে পুলিশ জাকির হোসেন নামের আরও এক আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। সবমিলিয়ে ৫ জন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু ঘটনার মূলহোতা ৬ আসামি। এদের মধ্যে কেউই গতকাল পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে এলাকায়। আড়াই মাসেও খুনিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রধান আসামি নাজমুল, গোলাম কিবরিয়া সোহাগ, রুবেল আহমদ, খালেদ মাসুদ ও আশরাফুল শাকিল।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোলাপগঞ্জ থানার এস আই সুরঞ্জিত কুমার দাশ গতকাল জানিয়েছেন- আসামিদের মধ্যে ৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। মূল ৬ আসামি ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে এরই মধ্যে কয়েক দফা সিলেটের বাইরের বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালানো হয়েছে। তবে- পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তারে সচেষ্ট রয়েছে। দ্রুতই আসামিরা গ্রেপ্তার হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। তবে- মামলার বাদী নিহত তারিফের ভাই তাহমিদুর রহমান জানিয়েছেন- ওরা নির্দয়ের মতো ওইদিন কুপিয়েছিল। এতে কয়েকজন গুরুতর আহত হন। আমার ভাই মারা যায়। আবু সুফিয়ানও মারা গেছেন। এখন আসামিরা গ্রেপ্তার না হলে এলাকায় স্বস্তি ফিরবে না। আসামিরা প্রকাশ্য ঘুরে বেড়াবে, আর আমাদের স্বজনরা কবরে ঘুমাবে তা তো হয় না। দ্রুত আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান তিনি। এবং প্রকাশ্য দিনদুপুরে হামলার ঘটনায় দুইজন নিহতের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন তিনি। এদিকে- নিহত আবু সুফিয়ানের লাশ সন্ধ্যায় সিলেটে এসে পৌঁছে। ময়নাতদন্ত শেষে আজ তার লাশ সমাহিত করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন স্বজনরা।