ওদের মৃত্যু কাউকে অপরাধী করে না!
প্রকাশিত হয়েছে : ২:০৪:১৪,অপরাহ্ন ২২ এপ্রিল ২০২২
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
ডালিয়া। কতইবা হবে মেয়েটির বয়স? চেহারায় এখনো কৈশোরের ছাপ। মেহেদী রাঙা হাত। সংসারটা মাত্র শুরু করেছে। জীবনটাও কি নয়! এরইমধ্যে বিধবা হয়ে গেল। নিউ মার্কেট বনাম ঢাকা কলেজ। সংঘাত-সহিংসতা কেড়ে নিলো দু’টি প্রাণ। নাহিদের পর মুরসালিন।
দুই যুবকের মৃত্যু তো কেবল দুইজন মানুষের মৃত্যু নয়। দু’টো পুরো পরিবার তছনছ হয়ে যাওয়া। মুরসালিনের দু’টি ছোট্ট সন্তানের দিকে তাকানো যায় না। কোথায় যাবে তারা এখন। কিংবা নাহিদের স্ত্রী, পিতা-মাতা। একদিকে স্বজন হারানোর গভীর বেদনা। অন্যদিকে, নিশ্চিত অনটনের ভবিষ্যৎ। তাদের দুঃখ- বেদনা বোঝার ক্ষমতা কোনো জিডিপি’র নেই।
সকাল থেকে কিছু লেখার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কখনও কখনও এমন হয়। সব গুলিয়ে যায়। কী বোর্ডে আঙ্গুল চলতে চায় না। ছবি এবং লেখাটা পুরনো। আগেও পড়েছি। অভিনেত্রী তানভীন সুইটি এবং কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের স্ট্যাটাসে ফের নজরে পড়লো। পোস্টে লেখা হয়েছে, ‘‘জাপানে বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ছেলেটি তার মৃত ভাইকে কবর দিতে পিঠে নিয়ে অপেক্ষা করছিল। একজন সৈন্য তাকে লক্ষ্য করে এবং তাকে এই মৃত শিশুটিকে নামিয়ে রাখতে বলে যাতে সে ক্লান্ত না হয়। শিশুটি জবাব দিলো, সে ভারী নয়, সে আমার ভাই।’’
ছবি বা বিবরণের সূত্রের আলোচনা ভিন্ন। কাকতালীয় কি-না জানি না। এই স্ট্যাটাস যখন পড়ছিলাম তার কিছু আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে অপেক্ষা করছিলেন এক ভাই। তিনি হতভাগা নূর মোহাম্মদ। মুরসালিনের বড় ভাই। কাঁধে ছোট ভাইয়ের লাশ। উপস্থিত সাংবাদিকদের বলছিলেন, ‘মামলা করবো না। কার বিরুদ্ধে মামলা করবো। এই দেশে কোনো বিচার নেই। কে করবে বিচার?’ কিংবা মুরসালিনের স্ত্রী অনি আক্তার মিতুর প্রশ্নের জবাবও বা দেবেন কে? তিনি জানতে চাচ্ছিলেন, আমার ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ কি? অনেকেই যখন আর বিচার চাচ্ছেন না নাহিদের স্ত্রী ডালিয়া অবশ্য বিচার চেয়েছেন। তার কথায়, ‘আমরা গরিব বইলা কেউ বিচারের কথা কয় না। কিন্তু আমি ন্যায্য বিচার চাই। গরিব বইলা আমাগো বিচার থাকবো না, তা না।’
বিচার চাওয়া, না চাওয়া নিয়ে সমাজে, রাষ্ট্রে নানা আলোচনা চলছে। আবুল কাসেম ফজলুল হক থেকে শুরু করে মুরসালিনের ভাই। কেন তারা বিচার চান না? আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? কী সমাজ রেখে যাচ্ছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। ব্যবসায়ী এবং ছাত্রদের মধ্যে গভীর রাতে দীর্ঘ বৈঠক শেষে আপাত সমঝোতা হয়েছে। মার্কেট খুলেছে। এবং আমাদের রিপোর্টার জানাচ্ছেন, সেখানে ভিড়ও বেড়েছে। এ ক’দিনে ব্যবসায়ীরা ধুমসে ব্যবসা করবেন সেটা আশা করাই যায়। চাঁদ রাতে তাদের আনন্দের কমতি হবে না। যে ছাত্র নেতারা এসব সংঘাতে অগ্রণী ভূমিকায় থাকেন তাদের আনন্দেও সম্ভবত কমতি হবে না। মাঝখানে দু’টি পরিবার একেবারে মাঠে পড়ে গেল। আগামী বহুদিন তাদের সংসারে কোনো ঈদ আসবে না।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। বলে রাখা দরকার, এদেশে একটি জনপ্রিয় থিওরি আছে, তৃতীয় পক্ষ। যখনই কোনো অশুভ ঘটনা ঘটে, বলা হয় এখানে থার্ড পার্টির হাত ছিল। যেন বাকি সব হাত নিরীহ, নিষ্পাপ। এবারের এপিসোডের শুরুটা হয় দু’টি দোকানের কর্মচারীদের মধ্যে। ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে পরিচিত কয়েকজনকে ডেকে নেয় তাদের একটি পক্ষ। সিটি করপোরেশন থেকে বরাদ্দ পাওয়া দোকান বহু আগেই ভাড়া দিয়ে দিয়েছিলেন নিউ মার্কেট থানা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি মকবুল হোসেন। অথচ সহিংসতার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তাকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে! গুজব, ঘটন, অঘটন। রক্তক্ষয়ী সংঘাত চললো দীর্ঘ সময়। এই সংঘাতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু আরও বড় প্রশ্নটি সম্ভবত ওঠেইনি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা রাজনীতিবিদদের মুখ দেখা যায়নি। অথচ এ ধরনের সংকট নিরসনে অগ্রণী ভূমিকায় থাকতে পারতেন তারা। চাঁদাবাজির প্রশ্নটি নিয়ে চাপানউতোর রয়েছে দীর্ঘদিনের। তেমনি নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের অশোভন আচরণের অভিযোগও পুরনো। এমনকি কর্মচারীদের কারও কারও বিরুদ্ধে ইভটিজিংয়ের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগও রয়েছে। সংঘাতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও হামলার শিকার হয়েছেন। অথচ কোনো পক্ষেই তাদের ভূমিকা ছিল না। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে সাংবাদিকদের যে ইচ্ছা দুই ঘা লাগিয়ে দিতে পারবে! প্রতিবাদ নেই, প্রতিকারতো বহুদূর।
ক্ষমতার দম্ভ ও দ্বন্দ্বের বলি হলো দু’টি জীবন, পরিবার। মামলা হয়েছে। বিচার কবে হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তার চেয়ে বিষয় হচ্ছে, নাহিদ-মুরসালিনদের মৃত্যু আদৌ কি আমাদের অপরাধী করে? কেন লোকে বিচার চায় না সে প্রশ্নের উত্তর কি আমরা খুঁজি?