সিলেটের কিনব্রিজের ‘ঠেলাওয়ালা’
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ এপ্রিল ২০২২, ৩:৫৫ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
বৈশাখ মাস চললেও গরম তেমন ছিল না। বরং হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে। এমন অবস্থায়ও দরদর করে ঘামছেন বয়স পঁয়তাল্লিশের আলম মিয়া। কোনো দিকে তাঁর খেয়াল নেই। মাথা নিচু করে একমনে রিকশার বডির পেছনের দিক ধরে যাত্রীসহ রিকশাটিকে ঠেলে নিচ থেকে ওপরের দিকে নিয়ে চলছেন। রিকশাটি সেতুর মাঝামাঝি অংশে দিয়ে আসার পর যাত্রীর কাছ থেকে তিনি পাচ্ছেন ১০ টাকা। এটাই তাঁর পেশা। এভাবেই আট বছর ধরে প্রতিদিন রিকশা ঠেলে পাওয়া টাকাতেই তিনি সংসার চালাচ্ছেন।
সিলেট নগরে সুরমা নদীতে ৮৬ বছর আগে স্থাপিত কিনব্রিজে গিয়ে গত বুধবার বিকেল পাঁচটার দিকে দেখা মিলল আলম মিয়ার। তিনি বলেন, সকাল আটটা থেকে তিনি রিকশা ঠেলতে শুরু করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি এ কাজ করেন। গড়ে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০টি রিকশা তিনি ঠেলতে পারেন। এতে তাঁর দৈনিক আয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এ টাকাতেই চলে তাঁর সংসার। তবে শ্রমের তুলনায় টাকা একেবারেই কম।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ধনুকের মতো বাঁকা সিলেটের কিনব্রিজ। রাস্তা থেকে ব্রিজের এপার-ওপার বেশ উঁচুতে হওয়ায় শুধু প্যাডেলের ওপর ভর করে এই সেতু পাড়ি দেওয়া বেশ কঠিন। এ কারণে রিকশাচালকদের দরকার পড়ে ‘ঠেলাওয়ালার’। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সেতুর উভয় পাড়ে হাড়ভাঙা খাটুনির এ কাজ করেন শতাধিক শ্রমিক। তাঁরা ‘কিনব্রিজের ঠেলাওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত।
সিলেট শহরকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে সুরমা নদী। দুই অংশকে সংযুক্ত করতে নদীর ওপর ১৯৩৬ সালে ধনুকের মতো বাঁকা একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। ১ হাজার ১৫০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৮ ফুট প্রস্থের লোহার তৈরি এ সেতুর নাম কিনব্রিজ। প্রতিবার রিকশা ঠেলে কিনব্রিজের ওপরে তুললে ঠেলাওয়ালার মজুরি মেলে ১০ টাকা। শিশু-কিশোর থেকে বয়স্ক মানুষও ঠেলাওয়ালার কাজ করেন। দিন শেষে একেকজনের জোটে গড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা।
একাধিক ঠেলাওয়ালা জানান, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের কাজ শুরু হয়। রাত নয়টার পর রিকশার চলাচল কমে এলে ঠেলাওয়ালারাও ধীরে ধীরে ঘরে ফেরেন। তবে কেউ কেউ রাত ১২টা পর্যন্ত রিকশা ঠেলার কাজ করেন। রোদ কিংবা বৃষ্টি—সব অবস্থাতেই তাঁদের রিকশা ঠেলতে হয়। কারণ, এর ব্যতিক্রম হলেই ওই দিনের আয় থেকে তাঁদের বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আহমদ মিয়া নামের এক তরুণ বলেন, দ্রুত রিকশা ঠেলতে পারেন তিনি। এ কারণে তাঁর আয়ও অন্যদের চেয়ে কিছুটা বেশি।
গতকাল বিকেলে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ঠেলাওয়ালার সঙ্গে কিনব্রিজে দাঁড়িয়ে কথা হয়। কাঁধে থাকা গামছা দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখ মুছে তিনি জানালেন, পুরোনো রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় অসুস্থ মা, স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকেন। ১০ বছর ধরে কিনব্রিজে রিকশা ঠেলছেন। বড় মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে। দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে কাপড়ের দোকানে চাকরি করে। বয়সের কারণে আগের মতো রিকশা ঠেলতে পারেন না তিনি। প্রতিদিন গড়ে তাঁর ২৫০ টাকা আয় হয়। তাঁর ও ছেলের আয়েই সংসার চলছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালানো তাঁদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে।
সুরমা নদীর উত্তর অংশ থেকে দক্ষিণ অংশে গতকাল বিকেলে রিকশায় করে যাচ্ছিলেন ভার্তখলা এলাকার বাসিন্দা নাজমুল ইসলাম (৩৪)। সঙ্গে স্ত্রী ফারিয়া আক্তার (২৪) ও তাঁদের দুই বছর বয়সী মেয়ে। তাঁদের রিকশা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিলেন আনুমানিক ২০ বছরের তরুণ এক ঠেলাওয়ালা। নাজমুল বলেন, প্রতিদিনই তাঁকে মূল শহরে সেতু পেরিয়ে যেতে হয়। বয়স্ক কিংবা শিশু যখন তাঁকে বহনকারী রিকশার ঠেলাওয়ালার কাজ করেন, তখন তাঁর অস্বস্তি লাগে। আবার মানাও করতে পারেন না, এতে ওই ঠেলাওয়ালার আয়ে টান পড়বে।