শিশু বিক্রি করেও আসল টাকা শোধ করতে পারলেন না মা
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৪৪:৩৮,অপরাহ্ন ১৯ এপ্রিল ২০২২
সুদ কারবারী লাকী বেগম। পরিবার নিয়ে থাকেন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার পাগলা আলীগঞ্জ এলাকায়। সরকারি চাকরি করেন স্বামী ও মেয়ের জামাই, তাই ক্ষমাতা ও দাপট অনেক। সেই সুযোগ নিয়ে নিরীহ দিনমজুর ও অসহায় শ্রমিকদের কাছে সুদে টাকা লাগাতেন তিনি। নিতেন চক্রবর্তী হারে সুদ। তা না পেলে নিতেন ঘরের আসবাবপত্র। এতেঅ টাকা শোধ না হলে নবজাতক শিশু বিক্রি করতেন লাকী বেগম।
এমনই ঘটনা ঘটেছে একই এলাকার রাণীর বেলায়। ৫ হাজার টাকা সুদে নিয়ে দিয়েছেন ২ লাখ টাকা। এরপরও শোধ হয়নি আসল টাকা। পরে তার এক বছরের শিশু বিক্রি করে টাকা নিয়েছেন লাকী। ঘটনাটি আলীগঞ্জ পিডব্লিউডি কলোনির।
স্থানীয়রা জানায়, মানুষের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে অন্তত পাঁচ বছর ধরে সুদের কারবার চালাচ্ছে একটি পরিবার। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে মো. আজাদ ও হজরত আলী নামে দুইজন চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারী। আর এতে সর্বস্বান্ত হয়েছে কলোনির নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ।
জানা গেছে, ভাগ্যবদলের আশায় বছর চারেক আগে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বাদুরতলা থেকে স্বামীর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ এসেছিলেন রাণী। ইট ভাঙার শ্রমিকের কাজ শুরু করেন। কলোনির সুদের মহাজন মো. আজাদের বাড়িতেই ভাড়া থাকেন তারা। আজাদের ছোট মেয়ে লাকী বেগমের কাছ থেকেই ঋণ নিয়েছিলেন রাণীর স্বামী হান্নান।
রাণীর অভিযোগ, দুই বছর আগে লাকীর কাছ থেকে স্বামীর নেয়া মাত্র পাঁচ হাজার টাকা ঋণের সুদ হিসেবে এ পর্যন্ত ২ লাখ ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। তারপর আরো ১ লাখ ৩ হাজার টাকা পাওনা বলে দাবি করছেন লাকী। টাকা শোধ করতে না পারায় তার ১ দিন বয়সী নবজাতককে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। এদিকে মারধরের ভয়ে রাণীকে রেখেই নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে পালিয়েছেন তার স্বামী।
সুদের জালে আটকা পড়ে নিজের সন্তানকে হারানোর কথা বলতে গিয়ে কাঁদেন রাণী। তিনি বলেন, দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে আমারে সর্বস্বান্ত করে দিছে। গর্ভে সন্তান আসার পর ওরে পেটে নিয়াই কাজ করছি। সেই সন্তান যখন জন্ম নিল, তখন আমারে না জানাইয়া একদিন বয়সী ছেলেরে বেইচা দিছে। কোথায় কার কাছে বিক্রি করছে জানি না।
কেবল রানী নয়, কলোনির এমন বেশ কিছু পরিবার সুদের মহাজন মো. আজাদ, তার মেয়ে লাকী বেগম ও জামাই হজরত আলীর ঋণের জালে সর্বস্বান্ত হয়েছে। ঋণ শোধ করতে না পারলে মারধর এমনকি মামলার আসামি পর্যন্ত হয়েছেন। দিনমজুর ইমামুল, ইউনুস মিয়া, চা দোকানদার বাবুল মিয়া, বৃদ্ধা রুবিনা বেগমসহ অন্তত ১৫ জন অভিযোগ করেন।
ফতুল্লা মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) তরিকুল ইসলাম জানান, অভিযোগ পেয়ে তদন্ত নেমে নিজস্ব সোর্স ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার দক্ষিণপাশা গ্রামে অভিযান চালিয়ে বাচ্চাটিকে উদ্ধার ও ক্রেতা রানু বেগমকে আটক করা হয়েছে। এ বিষয়ে মামলার প্রস্তুতি চলছে। তবে মূল হোতা লাকীকে এখনো গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
বাচ্চার ক্রেতা রানু বেগম জানান, তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেটি প্রতিবন্ধী। তাই তিনি একটি ছেলে দত্তক বা ক্রয় করার জন্য পরিচিতদের বলে রেখেছিলেন। এক বছর এক মাস আগে শ্যামপুর আফসার করিম রোডের আয়াত আলীর স্ত্রী সুমা তাকে ফোন করে জানান একটি বাচ্চা বিক্রি হবে। তখন ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে বাচ্চাটি ক্রয় করেন তিনি। বাচ্চাটির নাম রেখেছেন ইউসুফ।
সুমা জানান, তার বোন ঝর্নার মাধ্যমে বাচ্চা বিক্রির বিষয়টি জানতে পারেন তিনি। ঝর্নাকে জানিয়েছেন আলীগঞ্জের পিডব্লিউডি কলোনির শাহ আলমের ভাড়াটিয়া ফারুকের স্ত্রী রুবিনা। আর তাকে জানিয়েছেন সুদের কারবারি লাকী বেগম। লেনদেন শেষে বাচ্চাটিকে নিজেই রানু বেগমের হাতে তুলে দেন লাকী।