‘আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরাই ইলিয়াস আলীকে তুলে নিয়ে গেছে এটা নিশ্চিত’
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৩৫:৪৯,অপরাহ্ন ১৯ এপ্রিল ২০২২
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার ১০ বছর পূর্ণ হয়েছে রোববার। ইলিয়াস আলীসহ গুমের শিকার সকলকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে সোমবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে আলোচনা সভার আয়োজন করে বিএনপি। সেখানে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসীনা রুশদীর লুনা বলেছেন, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরাই যে ইলিয়াস আলীকে তুলে নিয়ে গেছেন, এটা নিশ্চিত। আর ঘটনার পর তাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে খুদে বার্তা পাঠিয়ে সাক্ষাতের আয়োজন এবং ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার আশ্বাস ছিল লোক দেখানো। ওই সময় বিএনপি’র পাঁচদিন হরতাল ছিল। বিএনপি’র সে হরতাল, আন্দোলনকে বন্ধ করার জন্যই ছিল ওই আশ্বাস।
তাহসীনা বলেন, বনানী দুই নম্বর রোডে আমার বাসা। আশপাশের সিকিউরিটি গার্ড, ডাব বিক্রেতা ছিল। ওই সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তাও সেখানে ছিল, যার কথা সংবাদমাধ্যমেও এসেছিল।
ধস্তাধস্তি দেখে উনি যখন গাড়ির সামনে গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, তখন তাকে আইনপ্রয়োগকারী একটি সংস্থার কার্ড শো করা হয়েছিল যে, তারা আইনের লোক।
আক্ষেপ প্রকাশ করে তাহসীনা রুশদীর বলেন, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা অনেকবার তাদের বাসায় এসেছে, অনেকদিন সিসি ক্যামেরাও লাগিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সেটা তদন্তের জন্য নয়। সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছিল বাসায় কারা কারা যাতায়াত করে সেটি দেখার জন্য। তিনি বলেন, ইলিয়াস আলী গুমের পর কোনো একজন মানুষকে উনারা থানায় নিয়ে গেছেন, বা কোথাও নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, এ রকম কোনো ঘটনা আমরা দেখিনি। তারা নির্লিপ্ত ছিল। সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্য ছিল খুবই মর্মান্তিক এবং পরিহাসমূলক।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ঘটনার পর আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা ইলিয়াস আলীকে গুম করার ঘটনা অন্য খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল। ঢাকা শহরে বিভিন্ন ধরনের পোস্টার ছাপিয়ে তারা ইলিয়াস আলীকে একজন খারাপ লোক হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
স্বামী নিখোঁজের পর গত ১০ বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তাহসীনা রুশদীর। তিনি বলেন, এই সরকার আমাদের নামের সঙ্গে একটি পরিচয় জুড়ে দিয়েছে। সেটি হলো আমরা গুম পরিবারের সদস্য। এই গুম পরিবারের সদস্য বলে অফিস-আদালত, দেশের যেখানেই যাই না কেন, মানুষ আমাদের এভাবেই দেখে। মানুষ ভয়ে কথা বলতে চায় না। গুম পরিবারের সদস্য মানে যেন আমরাও অপরাধ করেছি। আমাদের স্বামীকে গুম করা হয়েছে, এ অপরাধ সরকারের নয়, যেন এ অপরাধ আমাদের। সুতরাং আমাদের ছেলে মেয়েরা চাকরি পাবে না, কোথাও কাজ পাবে না। আমাদের ছেলেমেয়েদের এ দেশে বাস করার অধিকার নেই। এ রকম একটা ভাব বর্তমান সরকারের এবং তাদের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের।
তাহসীনা রুশদী বলেন, গুম হচ্ছে সরকারের পরিকল্পিত। পরিকল্পনা অনুযায়ী যারা মাঠের কর্মী, যোগ্যতাসম্পন্ন ছেলে, তাদের গুম করা হয়েছে-যাতে এর মাধ্যমে একটি মেসেজ দেয়া যে স্টপ হয়ে যাও। এগোলেই তোমাদের গুম করা হবে, খুন করা হবে। এ ধরনের একটি ভীতি সঞ্চার করেছিল, যাতে এই সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে না পারে, কেউ আন্দোলন করতে না পারে। সরকার অন্ধ হয়ে গেছে। গুমকে শিকার করতেই চায় না। কিন্তু অন্ধ হলেই তো প্রলয় বন্ধ হয় না। আল্লাহ’র কাছে দোয়া করি, সেইদিন পর্যন্ত আল্লাহ যেন আমাদের বাঁচিয়ে রাখেন। যেদিন এ সরকারের পতন দেখতে পারি এবং গুমের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচারটা যেন দেখে যেতে পারি।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তেব্যে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকারের ‘একদলীয় ও বাকশালীয় শাসন ব্যবস্থার’ বিরুদ্ধে যেসব তরুণরা প্রতিবাদ জানাচ্ছে তাদের নির্মূল ও নিশ্চিহ্ন করতেই সরকার তাদের গুম করে দিচ্ছে। আমার মনে আছে, যখন ইলিয়াস আলী গুম হয়ে যায় তখন আমি তার বাসায় গিয়েছিলাম, তার ছোট মেয়ের বয়স ছিল তখন ৬ বছরের মতো। সে শূন্য একটা দৃষ্টি নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। প্রায় প্রত্যেক বছরই আমি তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে তাদের বাসায় যাই। এখন দেখা করতে গেলে তার মেয়ে আমাদের সামনে আসে না, অনেক কষ্ট নিয়ে আসে না। বলে, ‘তোমরা আসো কিন্তু আমার বাবা তো ফিরে আসে না’।
মির্জা ফখরুল বলেন, গুম হয়ে যাওয়া প্রায় প্রত্যেকটি পরিবারের একই অবস্থা। আমার উত্তরার বাসার পাশেই দক্ষিণখান। সেখানে একজন মহিলা আছেন, তার ছেলে মুন্না গুম হয়ে গেছে। বাবা এক বছর বিভিন্ন জায়গায় ছেলেকে খুঁজতে খুঁজতে মারা গেছেন। আর মা এখন অসহায় অবস্থায় আছেন। তার ঘর ভাড়াও থাকে না। আমরা চেষ্টা করি অত্যন্ত সীমিতভাবে তাদের পাশে থাকার জন্য। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রতিটি পরিবারের খবর রাখেন। আমাদের মানবাধিকার সেল চেষ্টা করে গুমের বিষয়টিকে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করার জন্য। তারা সফলও হয়েছে।
গুম-খুনের শিকার পরিবারের সদস্যদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি এখন। এখন কোনো যুদ্ধ নেই। কোনো শত্রুর সঙ্গে লড়াই হচ্ছে না। অথচ আজকে তরুণদের গুম করে দেয়া হচ্ছে। তাদের একমাত্র অপরাধ, তারা পরিবর্তন চায়। তাদের কথাগুলো বলতে চায়, নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের জন্য সব রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বানও জানান মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, এই আন্দোলন হবে গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার জন্য। জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন- বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া, ঢাবি’র সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ, বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীরউত্তম, ইলিয়াস আলীর ছেলে আবরার ইলিয়াস, বৃটিশ হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি সালাওয়াত এডুফিসহ গুম হওয়া পরিবারের সদস্যরা।
আলোচনা সভায় নিখোঁজ সাইদুর রহমানের বাবা শফিকুর রহমান, মাজহারুল ইসলাম রাসেলের ভাই মশিউর রহমান, পারভেজ হোসেনের ছোট মেয়ে আদিবা হোসেন হৃদি, নুরুজ্জামান জনির স্ত্রী মুনিয়া আক্তার, মনির হোসেনের ভাই ওবায়দুল্লাহ হোসেন তাদের মনোবেদনা ও আকুতির কথা তুলে ধরেন।