লিবিয়ায় বন্দি ২৮ তরুণ, চেয়ারম্যান গুনছেন বান্ডিল-বান্ডিল টাকা
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:৩৪:৩৩,অপরাহ্ন ১১ এপ্রিল ২০২২
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
মাদারীপুরের ডাসার ও কালকিনি উপজেলার ২৮ তরুণকে ইতালি পাঠানোর নামে লিবিয়ায় বন্দি করে রেখেছে দালালচক্র। মানবপাচারের এ চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে এক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি সেই চেয়ারম্যানের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ভিডিওতে দেখা গেছে- চেয়ারম্যান বিপুল পরিমাণ টাকা গুনছেন।
স্থানীয় ও ভুক্তভোগীদের দাবি, মানবপাচারে সহায়তা করায় দালাল চক্রের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা কমিশন পেয়েছেন ঐ চেয়ারম্যান। সেই টাকা গোনার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, অবৈধপথে ইউরোপ নেয়ার কথা বলে লিবিয়ায় দালালদের হাতে বন্দি করা হয়েছে মাদারীপুরের ২৮ জন তরুণকে। দালালরা মুক্তিপণের জন্য তাদের জিম্মি করে নির্যাতন চালাচ্ছে।
এদিকে, দালাল চক্রের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কালকিনি উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফরহাদ মাতুব্বর। তিনি বলেন, টাকা নেয়ার সঙ্গে আমি জড়িত নই। ভুক্তভোগীরা দালালদের টাকা দেওয়ার সময় আমি শুধু সেখানে উপস্থিত ছিলাম।
ভুক্তভোগীদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ৪ মাস আগে ঐ ২৮ তরুণকে ইতালি পাঠানোর প্রলোভন দেখান চেয়ারম্যান ফরহাদ মাতুব্বর। এ জন্য প্রত্যেকের সঙ্গে ৯ লাখ টাকায় চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী প্রথমে সাড়ে চার লাখ টাকা দিতে হয়। লিবিয়া হয়ে ইতালি পৌঁছানোর পর নেয়া হয় বাকি সাড়ে চার লাখ।
চুক্তি অনুসারে, টাকা নিয়ে ২৮ তরুণকে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। লিবিয়া পৌঁছানোর পর প্রত্যেকের কাছ থেকে চুক্তির বাকি সাড়ে চার লাখ টাকা আদায় করা হয়। টাকা দেওয়ার পর তাদের লিবিয়ার দালালদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বর্তমানে বন্দি ঐ ২৮ তরুণের কাছে আরো ৩-৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে। তবে টাকা দিয়েও মুক্তি পাচ্ছেন না তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লিবিয়ায় বন্দি ২৮ জনের মধ্যে ৭ জনই ঐ ইউপি চেয়ারম্যানের নিজ এলাকার বাসিন্দা। তারা হলেন- সালাম ব্যাপারীর ছেলে মেহেদী ব্যাপারী, মোক্তার ব্যাপারীর ছেলে সাগর ব্যাপারী, করিম সরদারের ছেলে বনি সরদার, আলী ঘরামির ছেলে ফয়সাল ঘরামি, আমির ঘরামির ছেলে এনামুল ঘরামি, আদালি ঘরামির ছেলে সোহেল ঘরামি ও সৈকত ঘরামি। এছাড়া একই উপজেলার জনারদন্দি এলাকার আদেলউদ্দিন সরদারের ছেলে আহাদ সরদার, কবির সরদারের ছেলে হাসান সরদারসহ ১৯ জন তরুণ দালালদের হাতে বন্দি।
গোপালপুরের ভ্যানচালক মোক্তার ব্যাপারীর একমাত্র ছেলে সাগর ব্যাপারী। সে মা রেহানা বেগমের সঙ্গে সবশেষ ২০ দিন আগে কথা বলেছে। মায়ের সঙ্গে ছেলের শেষ কথা ছিল, ‘মা, তোমরা আমারে উদ্ধার কর। ওরা আমারে মাইরা ফালাইবে। যা টাকা চায়, ওদের দিয়া দাও।’
সাগরের বাবা মোক্তার হোসেন বলেন, সাগরের মুখে শেষ কথা শোনার পর আমাগো মাথায় আকাশ ভাইঙ্গা পড়ছে। কিছুই ভালো লাগে না। চেয়ারম্যানের কাছে আমরা কয়েকজন গেছি। চেয়ারম্যান আমাগো লগে দেখা করে না, কথাও বলে না। পুলিশ বা কাউকে জানালে ছেলেকে আর পাব না বলে ভয় দেখায়।
এদিকে, একাধিক ভুক্তভোগীর অভিযোগ এ ব্যপারে ডাসার থানায় মামলা করতে গেলে মামলা নেননি ওসি হাসানুজ্জামান।
মানবপাচার নিয়ে কথা হয় কালকিনি পৌরসভার মেয়র এস.এম হানিফের সঙ্গে। তিনি বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান ফরহাদের মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি শুনেছি। তার মাধ্যমে ২৮ তরুণ লিবিয়ায় গেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন আমার পৌরসভার বাসিন্দা। বিষয়টি পুলিশ ও প্রশাসনের গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত।
অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান ফরহাদ মাতুব্বর বলেন, রাসেল, সরোয়ার, ফারুক নামে বেশ কয়েকজন দালাল ঐ ছেলেদের লিবিয়ায় নিয়ে গেছে। আমি তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নই। এলাকার লোকজন আমাকে জানানোর কারণে টাকা দেওয়ার সময় আমি শুধু সেখানে উপস্থিত ছিলাম। এখন যারা আমার বিরুদ্ধে টাকা নেয়ার অভিযোগ করছেন, তাদের সঙ্গে আমি কোনো কিছুতে জড়িত নই। তাঁরা মিথ্যা বলছেন।
কালকিনির ইউএনও দিপংকর তঞ্চ্যাঙ্গা বলেন, ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ পাইনি। তারা সহযোগিতা চাইলে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
কালকিনি থানার ওসি ইশতিয়াক আশফাক রাসেল বলেন, ভুক্তভোগী ২৮ জনের অনেকেই পুলিশের সঙ্গে মানবপাচারের বিষয়টি আলাপ করেছেন। তারা মামলা করতে চান, আবার কিছুটা ভয়ও পান। তারা মনে করেন, মামলা হলে তাদের ছেলেকে লিবিয়ার দালালরা মেরে ফেলবে। দালালরাও ভয় দেখায় এটিও সত্য, তবে বিষয়টি পুলিশের নজরদারিতে আছে। ভুক্তভোগীরা আইনি সহায়তা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার গোলাম মস্তফা রাসেল জানান, মানবপাচারের ঘটনায় পুলিশ সতর্ক রয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা মামলা করতে আসে না। মামলা হলে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।