সিলেটে তুচ্ছ ঘটনায় বাড়ছে অপরাধ: এক সপ্তাহে ৬ জনের প্রাণহানী
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ এপ্রিল ২০২২, ১১:২৭ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
সিলেট বিভাগে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্রমাগত বাড়ছে অপরাধ। পারিবারিক কলহ, পূর্বশত্রুতার জের, সম্পর্কের অবক্ষয়, পরকীয়া, ব্যাবসায়িক ও ব্যক্তিস্বার্থের দ্বন্দ্ব, ছিনতাই, মামুলি বিষয় নিয়ে কথা-কাটাকাটি, এমনকি ঝগড়া-বিবাদ থামাতে গিয়েও একের পর এক ঘটছে হত্যাকাণ্ড। আহত হচ্ছে অনেকে। সিলেটজুড়ে গত সাত দিনে তুচ্ছ ঘটনায় অন্তত ৬ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
এর মধ্যে সর্বশেষ সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে মাত্র ৩৬ হাজার টাকাকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘর্ষে মোশাহিদ মিয়া (১৮) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরো অন্তত ১৫ জন। গতকাল রোববার দুপুরে উপজেলার দত্তপুর গ্রামে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এভাবে প্রতিনিয়ত অপ্রীতিকর ঘটনা বাড়ছে। ফলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মানুষ। এভাবে অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে পারিবারিক বন্ধনে ছন্দঃপতন ও প্রযুক্তির অপব্যবহারকে দায়ী করা হচ্ছে।
বানিয়াচং থানার (ওসি) মোঃ এমরান হোসেন জানান, দত্তপুর গ্রামের আব্দুল কাদির নামে এক ব্যক্তি হবিগঞ্জ শহরের রাজনগর বাইপাস রোড এলাকায় ভাঙাড়ির ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। আর তার ভাঙারির দোকানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো নিহত মোশাহিদ মিয়ার ফুফাতো ভাই হাফিজুল। গত ৩ মাস যাবত ব্যবসায়ী আব্দুল কাদির হাফিজুলের প্রতিমাসের বেতন ১২ হাজার টাকা করে মোট ৩৬ হাজার টাকা দেয়নি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে মনমালিন্য ও বাকবিতন্ডা হয়। এক পর্যায়ে শালিশ বৈঠকে হাফিজুলের ৩৬ হাজার টাকা দেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত হয়ে বিষয়টি মিমাংসা করা হয়।
তিনি বলেন, রোববার এ বিষয়ে নিয়ে আবারো গ্রামের বাড়িতে উভয়পক্ষের মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়। এক পর্যায়ে উভয়পক্ষ দেশীয় অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে সুজাতপুর ফাঁড়ি পুলিশ ও বানিয়াচং থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে। গুরুতর আহত অবস্থায় মোশাহিদকে উদ্ধার করে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ দেবাশীষ রায় তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এছাড়াও রায়হান মিয়া, ডালিম আহমেদ, সালমা বেগম, জুয়েল মিয়া, ছবুর আহমেদ, রেজাক মিয়াসহ অন্তত ১৫ জনকে উদ্ধার করে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ওসি আরো বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। ফের সংঘর্ষ এড়াতে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
আগের দিন শনিবার সিলেটে সিনিয়র জুনিয়র দ্বন্দ্ব নিয়ে ছুরিকাঘাতে নাজিম আহমদ (১৯) নামের এক যুবক খুন হন। শনিবার রাত ১০টার দিকে নগরের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ইমার্জেন্সি গেটের সামনে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনায় জুয়েল আহমদ (২৪) নামের এক যুবককে আটক করেছে পুলিশ।
নিহত নাজিম সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার নুর মিয়ার ছেলে। সিলেট নগরের দরগাহ মহল্লার ৭৪ নং বাসায় ভাড়া থাকতেন। তিনি পেশায় হোটেল শ্রমিক। আটক জুয়েল নগরের মুন্সিপাড়ার বাসিন্দা। তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করেন।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি উত্তর) আজবার আলী শেখ বলেন, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব নিয়ে শনিবার রাতে ওই দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে জুয়েল নামের যুবক নাজিমকে ছুরিকাঘাত করেন। এতে নাজিমের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পুলিশ জুয়েলকে আটক করেছে। তার বিরুদ্ধে থানায় আরও মামলা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আটক জুয়েল প্রাথমিকভাবে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
এর আগে একইদিন ভোর ছয়টার দিকে সিলেট সদর উপজেলার এয়ারপোর্ট থানাধীন সাহেবের বাজারে জমিসংক্রান্ত সংক্রান্ত বিরোধের জেরে দু’পক্ষের সংঘর্ষে ডা. মো. নিজাম উদ্দিন নামে এক পল্লী চিকিৎসক নিহত হয়েছেন। তিনি বাজারতল গ্রামের মৃত বশির উদ্দিনের ছেলে। ঘটনার পর পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে এ ঘটনায় জড়িত ৪ জনকে আটক করেছে।
একইভাবে গত শুক্রবার বড়লেখা সদর ইউপির কেছরিগুল কাটাকাটি জের ধরে রুবেল আহমদ (২৮) নামে এক যুবককে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
জানা যায়, শুক্রবার বড়লেখা সদর ইউপির কেছরিগুল কাটাকাটি হয়। পরে এলাকার লোকজন বিষয়টি সমাধান করে দেন। আসরের নামাজের সময় জামাল আহমদের ছেলে ও ভাতিজাদের সঙ্গে সদর ইউপির মেম্বার সাবুল আহমদের ভাই সরফ উদ্দিন নবাবের ছেলে ও ভাতিজাদের ঝগড়া হয়। ঘটনার সময় রুবেল আহমদ কাজ শেষে বাড়িতে ফিরছিলেন। এ সময় তাকে (রুবেলকে) জামাল আহমদের পক্ষের লোক ভেবে আটকে রেখে মারধর শুরু করেন ইউপির মেম্বার সাবুল আহমদ ও তার ভাই সরফ উদ্দিন নবাব গংরা। একপর্যায়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করলে রুবেল গুরুতর আহত হন। রুবেলকে বাঁচাতে গিয়ে তার ভাই সুমন আহমদও আহত হন। পরে স্থানীয়রা রুবেলকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তার আগে গত ৪ এপ্রিল মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের বাসিন্দা ফার্নিচার ব্যবসায়ী আতিকুর রহমান সুমনকে (২৮) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। সোমবার ভোর ৫টার দিকে নবীনগর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের বাঘাউড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহত আতিকুর রহমান সুমন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ পৌর এলাকার আলেপুর গ্রামের মৃত আবু মিয়ার ছেলে।
সুমন হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে সুমনের সহযোগি সোহেল মিয়াসহ ৪ জনকে আটক করেছে পুলিশ। আটক সোহেল কমলগঞ্জ পৌর এলাকার আলেপুর গ্রামের ফারুক মিয়ার ছেলে।
এর আগে গত ৩ এপ্রিল সিলেটের জৈন্তাপুরের হরিপুর বাজারে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে দু’পক্ষের প্রায় ১০ ঘন্টাব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে পরদিন ভোরে মধ্যস্তাকারী একজন নিহত হয়েছেন। তার নাম হাফেজ সালেহ আহমদ। নিহত সালেহ আহমদ স্থানীয় হেমু গ্রামের বাসিন্দা ও সিলেট নগরের মেজরটিলা তাহফিজুল কোরআন মাদ্রাসায় শিক্ষক।
হত্যাকাণ্ডের ৩ দিন পর গত বৃহস্পতিবার নিহতের ভাই নুর উদ্দিন বাদি হয়ে জৈন্তাপুর থানায় এ মামলা দায়ের করেন। মামলায় উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান রফিক আহমদসহ ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১২-১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারনামীয় আসামিদের সবাই হেমু হাউদপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। মামলায় অভিযুক্ত চেয়ারম্যান রফিক আহমদও ওই গ্রামের মৃত আহমদ আলীর ছেলে। এছাড়াও দুই গ্রামের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছে। থানার এসআই শহিদুল ইসলাম বাদি হয়ে উভয় পক্ষের এক হাজারের বেশি লোককে আসামী করে এই মামলা দায়ের করেন।
এছাড়াও গত বুধবার রাত পৌনে ৮টার দিকে সিলেট নগরীর ছড়ারপার ও মাছিমপুর এলাকাবাসীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষ চলাকালে কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ শোনা গেছে। ইটপাটকেল নিক্ষেপে কয়েকজন আহত হয়েছেন। হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয় সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের বাসভবন।
একটি সূত্র জানায়, রাস্তার জায়গা নিয়ে কয়েকদিন ধরে ছড়ারপাড় ও মাছিমপুরের লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। এ নিয়ে মঙ্গলবার ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম মুনিম ও ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোস্তাক আহমদের উপস্থিতিতে বৈঠক হয়। কিন্তু বৈঠকে কোন সমাধান হয়নি। এর জের ধরে বুধবার উভয় পাড়ার লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
জৈন্তা বার্তা