বাজার গরম: এবার রোজাদাররা স্বস্তি পাবে তো?
প্রকাশিত হয়েছে : ২:৩৯:০৮,অপরাহ্ন ০২ এপ্রিল ২০২২
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে প্রায়ই। রোজা উপলক্ষে বাজার হয়েছে আরও কিছুটা অস্থির। রাজধানীর একটি বাজার থেকে তোলা ছবি। নিউজবাংলা
সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে, বাজার তদারকি বাড়িয়েছে। তবু নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার প্রবণতায় হেরফের নেই। রাজধানীর আগারগাঁও, তালতলাসহ কয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে দেখেছে, এরই মধ্যে ছোলা, ভোজ্যতেল, খেঁজুর, চিনি, ডাল, গুঁড়া দুধসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। অথচ রমজানে বেশি ব্যবহার হওয়া ওই সব পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি নেই।
সংযমের আর আত্মশুদ্ধির মাস রমজান এলে জিনিসপত্রের দাম বাড়া একটা নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। রমজানকে সামনে রেখে ‘বাড়তি’ চাহিদার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফার আশায় নিত্যপণ্যসহ অন্যান্য জিনিসিপত্রের দাম অস্থিতিশীল করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
দাম বাড়ার এই প্রবণতায় স্বল্প ও নির্ধারিত আয়ের চাকরিজীবীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কারণ যে হারে পণ্যের দাম বেড়েছে, সেই হারে তাদের আয় বাড়েনি।
সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁও, তালতলাসহ কয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে দেখে যায়, এরই মধ্যে ছোলা, ভোজ্যতেল, খেঁজুর, চিনি, ডাল, গুঁড়া দুধসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। অথচ রমজানে বেশি ব্যবহার হওয়া ওই সব পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি নেই।
দাম বাড়ার জন্য আগের মতোই এবারও ব্যবসায়ীরা পরস্পরকে দোষারোপ করছেন।
ভোক্তা পর্যায়ের খুচরা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, পাইকারদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হয় বিধায় ভোক্তাদের ওপর প্রভাব পড়ছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, জাহাজ ভাড়াসহ অন্যান্য পরিবহন খরচ বাড়ায় জিনিসপত্রের দামে প্রভাব পড়ছে বলে জানান পাইকারি ব্যবসায়ী ও উৎপাদকরা।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, করোনা-পরবর্তী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে– এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে পণ্যের দাম বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে দেশের বাজারে। তা ছাড়া জিনিসপত্রের দাম একবার বাড়লে তা আর কমে না।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মার্চের শেষে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলেছে, বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে চাল, ডাল,আটাসহ নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেশি। এর জন্য দুর্বল বাজার ব্যবস্থা ও তদারকিকে দায়ী করেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ নিয়ে গত সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভা শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের জানান, নিত্যপণ্যের বাজার সহনীয় রাখতে সরকার কর ছাড়সহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব পদক্ষেপের ফলে আশা করা যাচ্ছে, অচিরেই বাজার স্থিতিশীল হবে।
ইতোমধ্যে কিছু কিছু পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে বলে দাবি করেন বাণিজ্যমন্ত্রী। কিন্তু মন্ত্রীর এ বক্তব্যের বাস্তব প্রতিফলন তেমন নেই, শুধু পেঁয়াজ ছাড়া।
খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রোজা উপলক্ষে প্রতি কেজি ছোলার দাম বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।
তালতলা বাজারে বৃহস্পতিবার এক কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়।
তালতলা বাজারের মাসুম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মিজান বলেন, ‘পাইকারি বাজারে বেশি দাম দিয়ে আনতে হয়েছে। তাছাড়া পরিবহন খরচও অনেক বেড়েছে। এসব কারণে ছোলার দাম বেড়ে গেছে।’
দেশে ছোলার বর্তমান চাহিদা ১ লাখ টন। এর মধ্যে রোজার মাসেই লাগে ৮০ হাজার টন।
তালতলা বাজারে সাধারণ মানের এক কেজি খেজুর বিক্রি হয় ৩০০ টাকায়। রোজার আগে দাম ছিল ২৫০ টাকা। কেজিপ্রতি খেজুরের দাম বেড়েছে ৫০ টাকা বা ২৫ শতাংশ। দেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা ৪০ হাজার টন হলেও রমজানে লাগে ২৫ হাজার টন।
মসুর ডালের দাম বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। আর খেসারি বেড়েছে ১৫ শতাংশ। বাজারভেদে এখন প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭৮ থেকে ৮০ টাকায়। যেখানে রোজার আগে বিক্রি হতো ৭০ টাকায়। দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা ২০ লাখ টন।
বিপুল পরিমাণ করছাড় দেয়ার পরও ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা কাটেনি এখনও। এক লিটার সয়াবিন তেল কোনো কোনো বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৬৮ টাকায়। আবার কোথাও তা ১৬৪ টাকায়।
রমজানের বাজার স্থিতিশীল রাখতে তদারকি ব্যবস্থা কঠোর করা হয়েছে বলে জানালেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার।
তিনি বলেন, ‘নিত্যপণ্যের বাজার আমরা নিয়মিত তদারকি করি। রমজানে সপ্তাহে সাত দিনই আমাদের টিম বাজার তদারকি করবে। অধিদপ্তরের ছয়টি আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চারটিসহ এবার মোট ১০টি টিম মাঠে থাকবে।’
তিনি বলেন, এরই মধ্যে ছোলা, খেজুরের দাম সম্পর্কে খোঁজখবর করা হয়েছে এবং ভোজ্যতেলের বাজারে অভিযান চালানো হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম পাওয়া গেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। রমজান মাসজুড়েই বাজার তদারিক করা হবে বলে জানান তিনি।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করে ক্যাবের সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যসচিব গোলাম রহমান মনে করেন, ব্যবসায় মুনাফা অর্জন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু মুনাফা অর্জনের নামে অনৈতিক কর্মকাণ্ড সমর্থনযোগ্য নয়। আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ সব ধরনের পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারকে আরও বেশি তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি দেশের ব্যবসায়ীদের আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কারণ পণ্যের বাজার বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং অভ্যন্তরীণ সরবরাহের উপর নির্ভর করে। সাধারণ নিয়মে বিশ্ববাজারে যেহেতু পণ্যের দাম বেড়েছে, বাংলাদেশেও বাড়বে। এটাই স্বাভাবিক।
তিনি মনে করেন, ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, সারসহ কিছু স্পর্শকাতর পণ্যের মূল্য কমিয়ে রেখেছে সরকার। তা না হলে দেশে পণ্যের দাম আরও বেড়ে যেত।
বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে সম্প্রতি সিপিডি যে মন্তব্য করেছে তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমাদের দেশে শুল্ক হার বেশি থাকার ফলে পণ্যের দাম বেশি পড়ে।
তিনি বলেন, বর্তমানে ভোক্তারা পৃথিবীজুড়ে অস্বস্তিতে আছে। অবশ্যই ভোক্তারা দুর্ভোগে আছেন। আরও বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হতো, যদি ভর্তুকি না দিত সরকার।
নিউজ বাংলা