দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাষ্ট ও বিশুদ্ধ কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৩১:৩৭,অপরাহ্ন ২৮ মার্চ ২০২২
পৃথিবীতে যত ধর্মগ্রন্থ রয়েছে তাঁর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে আল কুরআন। মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে আল্লাহ পাক মানব জাতির হেদায়েতের জন্য অসংখ্য নবী রাসুল প্রেরণ করেছেন এবং প্রত্যেক নবী কে আসমানী কিতাব দিয়েছেন।এর মধ্যে প্রধান আসমানী চারটি কিতাবের মধ্যে পবিত্র কুরআন শরীফ হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব।যার মধ্যে কোন প্রকার সংশয় সন্দেহ নেই। আল্লাহ পাক বলেন হে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমি এই কিতাব নাজিল করেছি এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ আমিই করবো। পৃথিবীর কেউই এই কিতাবের পরিবর্তন করতে পারবেনা। পৃথিবীর বুকে একটি মাত্রই কিতাব কুরআন যেটিকে সুন্দর ও শুদ্ধ করে পড়তেই হয়। অশুদ্ধ উচ্চারণের কারণে কুরআনের অর্থের বিঘ্নতা ঘটে। তাই এই মহাগ্রন্থের বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের জন্য বাংলাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম যুগের মুজাদ্দিদ শামসুল ওলামা আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (রহঃ) ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাষ্ট।
দারুল কিরাত প্রতিষ্ঠাঃ
আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (রহ) ভারতের উত্তর প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী রামপুর আলীয়া মাদরাসা থেকে হাদিস, তাফসির, ফিকহ বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে বর্তমান ভারতের করিমগঞ্জ জেলার বদরপুর আলীয়া মাদরাসায় অধ্যাপনায় নিয়োজিত হন। এ সময় স্বীয় মুর্শিদ আবু ইসুফ শাহ মোহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরীর নির্দেশে ইলমে কিরাতের উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য মক্কা শরীফ গমন করে তৎকালীন শ্রেষ্ঠ বুজুর্গ ও কারী হযরত আহমদ হেজাজী মক্কী (রহ.) এর কাছ থেকে ইলমে কিরাতের সনদ লাভ করেন। সেখান থেকে ফিরে এসে আবার বদরপুর আলীয়া মাদরাসায় অধ্যাপনা শুরু করেন। একদিন আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী ক্লাসে ছাত্রদের দরস দিচ্ছেন, এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন হযরত আব্দুন নুর গড়কাপনী (রহ.) তিনি তৎকালীন খ্যাতিমান আলিম ও বুজুর্গ ছিলেন। ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (রহঃ) তাঁকে অত্যান্ত সম্মানের সাথে পাশে বসালেন, এবং আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। জবাবে তিনি বল্লেন সর্বসাধারণের কথা তো দুরের এ অঞ্চলের অনেক আলিম ওলামারও কিরাত শুদ্ধ নয় তাই আপনি আমাদের কে কুরআন শিক্ষা দিন। ছাহেব কিবলাহ জবাবে জানালেন আমার সময় নেই। ছাত্রদের কে দরস দেওয়ার পূর্বে কিতাব দেখে নিতে হয় তাই সময় একদম পাই না। তারপর উনি চলে গেলেন পরদিন আবার চলে আসলেন এবং বললেন আমি উপর থেকে হুকুম পেয়ে আসছি। ছাহেব কিবলাহ বললেন সাব বলেছেন কি? ( উনার মুর্শিদ বদরপুরীর কথা)। আব্দুন নুর সাহেব বললেন না। আমার সাথে হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দিদার হলো, হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করলেন, আমি আরজ করলাম ইয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরকম তিলাওয়াত শিখতে চাই। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডানদিকে ইশারা করলেন আমি চেয়ে দেখলাম সেখানে সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি আপনি বসা। সাথে সাথে ছাহেব কিবলাহ দাঁড়িয়ে গেলেন,এবং কেঁদে ফেললেন,আর বললেন ঠিক আছে আমি প্রতি বৃহস্পতিবার ১২ টার পরে আদম খাকী (রহ.) এর মাজার সংলগ্ন স্তানে পড়াবো। এভাবে ১৯৪৬ সাল থেকে ছাহেব কিবলাহ ফুলতলীর ইলমে কিরাতের সুত্রপাত হয়।
দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাষ্ট গঠনঃ
আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী ১৯৫০ সালে নিজ বাড়িতে ইলমে কিরাতের দরস শুরু করেন। সে সময়ে ছাত্রদের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক গণও দরস গ্রহণ করতেন। কুরআন নাজিলের মাস হিসাবে রামদ্বান মাস কে কুরআন শিক্ষার উপযুক্ত সময় হিসাবে নির্ধারণ করা হয়। ক্রমান্বয়ে ছাত্রদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে এর একটি সতন্ত্র ট্রাষ্ট গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়। ঐ সময় সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি ট্রাষ্ট গঠন করা হয়। ট্রাষ্টের সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (রহ.) এর পিতা মুফতি আব্দুল মজিদ চৌধুরীর নামানুসারে ট্রাষ্টের নামকরণ করা হয় দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাষ্ট। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ আজীবন ট্রাষ্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। উনার নিজ বাড়িতে নিজ খরছে ট্রাষ্ট টি পরিচালিত হচ্ছে। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) নিজ সম্পদের ৩৩ একর জমি দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাষ্ট এর নামে ওয়াকফ করে দেন। ট্রাষ্ট এর প্রধান কার্যালয় ফুলতলী ছাহেব বাড়ীতে আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী সাহেবের দক্ষ পরিচালনায় অত্যান্ত সুন্দর ও সুচারু রুপে পরিচালিত হচ্ছে।
শাখা ও কেন্দ্র সমুহঃ
আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলীর নিজ বাড়িতে অনুষ্ঠিত দরসে দিন দিন ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভিন্ন স্তানে শাখা কেন্দ্র অনুমোদন দেওয়া হয়। দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাষ্ট এর মোট ছয়টি শ্রেণি রয়েছে। যথা আউয়াল, ছানী,ছালিছ,রাবে, খামিছ,ছাদিছ। ছানী জামাত থেকে ছাদিছ পর্যন্ত কুরআন শরীফের পাশাপাশি ছাহেব কিবলাহ রচিত আল কাউলুছ ছাদিদ পড়ানো হয়। এবং সুরা ও আউয়াল জামাতে ছাহেব কিবলাহ (রহ.)এর বড় ছাহেব জাদা আমাদের বর্তমান মুর্শিদ আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী রচিত প্রাথমিক তাজবীদ পড়ানো হয়। বিভিন্ন শাখা কেন্দ্রে সর্বোচ্চ খামিছ পর্যন্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। সমাপনী জামাত ছাদিছ ছাহেব বাড়ীতে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার ছাত্র ছাত্রী (ছাত্রীরা শুধু পরিক্ষার সময় ছাহেব বাড়ীতে অবস্থান করেন)পূর্ণ রামাদ্বান মাসে ছাহেব বাড়ীতে অবস্থান করে দরস গ্রহন কিরাতের সনদ গ্রহন করেন।
সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য সোসাইটি গঠনঃ
দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাষ্ট এর আওতাধীন দেশ বিদেশে প্রায় আড়াই হাজার শাখা কেন্দ্র রয়েছে।প্রতি বছর দেশ বিদেশে শাখা কেন্দ্র সমুহ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। উক্ত শাখা কেন্দ্র সমুহ কে সুন্দর ও সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য দেশের প্রায় উপজেলায় লতিফিয়া ক্বারী সোসাইটি গঠন করা হয়েছে। প্রধান কার্যালয়ের দিক নির্দেশনায় উপজেলা পর্যায়ের সোসাইটি সমুহ সম্পুর্ন অবৈতনিক ভাবে উপজেলা বৃত্তিক শাখা কেন্দ্র সমুহের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
নবীজীর প্রকৃত উত্তর সুরী হিসাবে দায়িত্ব পালনঃ
পৃথিবীর বুকে আল্লাহ পাক তাঁর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে প্রেরণ করেছেন যে মানব জাতির কাছে এই কিতাব তিলাওয়াত করে শুনাবেন এবং এর হেকমত শিক্ষা দিবেন। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাষ্ট প্রতিষ্ঠা করে মানুষের কাছে মহাগ্রন্থ আল কুরআন বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের মাধ্যমে নবীজীর যোগ্য উত্তর সুরী হিসাবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
বিশুদ্ধ কুরআন শিক্ষার গুরুত্বঃ
আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন মজিদে এরশাদ করেন, তোমরা পবিত্র কুরআন মাজিদ তারতীলের সহিত তিলাওয়াত করো। অর্থাৎ ধীরস্থির ভাবে সহি শুদ্ধ করে। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) এর প্রতিষ্ঠিত দারুল কিরাতের মাধ্যমে মানুষদের কে বিশুদ্ধ ভাবে তারতীলের সহিত কুরআন শিক্ষা দিয়ে মহান আল্লাহ পাকের হুকুম বাস্তব প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে এবং অন্যকে কুরআন শিক্ষা দান করে। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) এর দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাষ্ট প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহ পাক ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদেশ বাস্তবায়িত করেছেন।
আল্লাহর নৈকট্য লাভে বিশুদ্ধ তিলাওয়াতঃ
আল্লাহ পাক বলেন আমি মানব ও জীন জাতিকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাই মানুষ হিসাবে আমাদের উচিত আল্লাহর ইবাদত করে তাঁর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা। আমরা ঈমান আনার সাথে সাথেই আল্লাহ পাক আমাদের উপর নামাজ ফরজ করে দিয়েছেন। আর এই নামাজ কে পরিপূর্ণ ভাবে আদায় করতে হলে বিশুদ্ধ তিলাওয়াত অবশ্যই প্রয়োজন। তিলাওয়াত শুদ্ধ না হলে নামাজ কবুল হয় না। তাই আল্লাহর নির্ধারিত ফরজ আদায় করতে বিশুদ্ধ করে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন।
পরিশেষে বলা যায় যে মুসলিম জাতিকে বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা দানে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) এর প্রতিষ্ঠিত দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাষ্ট এর মাধ্যমে কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।