সিলেটে উন্নয়নে ঢাকা পড়েছে ইতিহাস
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:২১:৫২,অপরাহ্ন ২৫ মার্চ ২০২২
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
সিলেট নগরীর প্রবেশদ্বার হুমায়ুন রশীদ চত্বর থেকে কয়েকশ গজ উত্তরে আরেকটি চত্বর; যা মুক্তিযোদ্ধা চত্বর নামে পরিচিত। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে এখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। সেদিনের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় কার্যত সিলেটকে শত্রুমুক্ত করে। সেই স্মৃতিতে নগরীর কদমতলীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল সংলগ্ন চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। পাঁচ বছর আগে উন্নয়নের স্বার্থে মুক্তিযোদ্ধা চত্বরের স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। তখন আরও সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের আশ্বাস দেওয়া হয়। তবে এত দিনেও স্মৃতিস্তম্ভের জন্য সিসিক পছন্দের নকশা পাচ্ছে না! এ নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।
১৯৯৬ সালে দক্ষিণ সুরমার কদমতলীতে মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে শ্বেতপাথর দিয়ে পিরামিড আকৃতির স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। এই স্মৃতিস্তম্ভের ওপর পতপত করে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়ত। হুমায়ুন রশীদ চত্বর থেকে এই পথেই প্রতিদিন শত শত গাড়ি কদমতলীয় কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে আসা-যাওয়া করে। ফলে হাজারো মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় স্মৃতি দেখে উদ্বেলিত হতেন। ঐতিহ্যবাহী কিস্ফনব্রিজের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে সুরমা নদীর তীরবর্তী ঝালোপাড়া হয়ে মুক্তিযোদ্ধা চত্বর পর্যন্ত সড়ক সংস্কারের উদ্যোগ নেয় সিসিক। এই সড়কটি ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রশস্ত করা ও নদীর তীরে দৃষ্টিনন্দন ওয়াকওয়ে নির্মাণের সময় মুক্তিযোদ্ধা চত্বরের স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলা হয়। দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত চত্বরটি এখন গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান।
কদমতলী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা চত্বর হয়ে তিনটি সড়ক দেশের বিভিন্ন জায়গায় গেছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ছাড়াও সিলেট-জকিগঞ্জ-গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার এবং সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ-মৌলভীবাজার সড়কের যানবাহন মুক্তিযোদ্ধা চত্বর ঘুরেই আসা-যাওয়া করে। সম্প্রতি বাস টার্মিনালে সংস্কার কাজ চলছে। ফলে বিভিন্ন রুটে শত শত বাস মূল সড়কে পার্কিং করা থাকে। বাস টার্মিনাল সংলগ্ন হওয়ায় অনেক বাস-ট্রাক মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে রাখা হয়। এখানে প্রতিনিয়ত গাড়ি ধোয়ামোছার কাজ হয় বলে সারাক্ষণ পানি জমে থাকে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এই চত্বরের স্থাপনা দেখে আগে মানুষ ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারত। কয়েক বছর ধরে চত্বরে স্মৃতিস্তম্ভ না থাকায় কেউ আগ্রহ দেখায় না।
এ নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও ক্ষোভ-হতাশা রয়েছে। বহুবার দাবি জানানোর পরও সিসিক তাতে কর্ণপাত করেনি।
এ প্রসঙ্গে সিলেট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল বলেন, সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের আগে এই চত্বর নির্মাণের কথা ছিল। অথচ সিটি করপোরেশন তা ফেলে রেখেছে। এটা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি চরম অবমাননা। একাত্তরের গৌরবের ঐতিহ্য লালনের প্রতি অনীহা প্রদর্শন। তিনি বলেন, বর্তমান মেয়র মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বড় বড় কথা বলেন, আশ্বাস দেন। কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা চত্বরের কাজ শেষ করার কথা ছিল। তার বদলে ফেলে রাখা হয়েছে। তারা দাবি জানানো ছাড়া আর কী করতে পারেন বলে আক্ষেপ করেন এই মুক্তিযোদ্ধা।
মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ভবতোষ রায় বর্মণ বলেন, উন্নয়ন কাজের নাম করে মুক্তিযোদ্ধা চত্বরের আগের স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়। তখন আরও সুন্দর, আকর্ষণীয় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। এতদিন পরও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তিনি বলেন, নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্মৃতিস্তম্ভ থাকলে মানুষ ইতিহাস সম্পর্কে জানার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করত। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তা ভীষণ কষ্টের।
মুক্তিযোদ্ধা চত্বর ফেলে রাখলেও পাশেই আধুনিক পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করেছে সিসিক; যার নামকরণ করা হয়েছে এই চত্বরের নামে। ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী পাবলিক টয়লেটের উদ্বোধন করার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়। অনেকে বিএনপি নেতা মেয়র আরিফের উদ্যোগকে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন বলে অভিযোগ করেন। সে সময় মুক্তিযোদ্ধা চত্বরের জন্য নকশা চেয়ে দরপত্র আহ্বানের কথা জানিয়েছিল সিসিক।
নকশা পছন্দ না হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা চত্বরের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না জানিয়ে সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, নকশা তো পছন্দ হয় না। ভালো নকশা মিলছে না। কয়েকটি পেয়েছিলেন। সেগুলো পছন্দ হয়নি। এরপর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছিল। এখন দুটি ফার্মের নকশা দেখে তাদের বিস্তারিত দিতে বলা হয়েছে। নকশা চূড়ান্ত হলেই দ্রুত কাজ শুরু করা হবে। সুত্র- সমকাল