টিসিবি’র পণ্য: শিশু কোলে ৪ ঘণ্টা লাইনে ফাতেমা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ মার্চ ২০২২, ১২:৩১ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
ফাতেমা খাতুনের কোলে দুই বছরের শিশু সাদিয়া। শিশুটি হার্টে ছিদ্রসহ জটিল রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য নেই সাদিয়ার বাবা মিরাজ শেখের। রিকশা চালিয়ে সামান্য আয় করেন। পাঁচ জনের সংসারে তা দিয়ে দুইবেলা খেয়ে জীবন চালানো কঠিন হয়ে পড়ে তার। এরমধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাকাল পরিবারটি। কিছু টাকা সাশ্রয় করতে ফাতেমা অসুস্থ সন্তানকে কোলে নিয়েই রোদের মধ্যে ৪ ঘণ্টা ধরে টিসিবি’র লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মতো অনেকেই আছেন লাইনে।
গরমে হাঁসফাঁস করছে শিশুটি। মাঝে মধ্যে কান্নাও করছে। সন্তানকে কোলে নিয়ে মানুষের ধাক্কাধাক্কি সামাল দিতে কষ্ট হচ্ছে ফাতেমার। মেয়ের কষ্ট দেখে অশ্রুসিক্তও হয়েছেন তিনি। তবুও আশায় আছেন কম খরচে তেল, ডাল, চিনি আর পিয়াজ কেনার। ফাতেমা জানান, ট্রাক থেকে দ্রব্য কেনা অনেক কষ্টের। রোদের মধ্যে চার-পাঁচ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। নইলে পণ্য পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ। যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়াইতাছে আমরা খাবো কীভাবে? তেল, পিয়াজ সব কিছুর দামই বাড়াই দিছে। জিনিসপত্রের দাম কমালে আমাদের সিরিয়াল দিয়া দাঁড়াইতে হতো না। দোকান থেকেই আমরা কিনে নিতাম। এত কষ্টও হতো না। অসুস্থ মাইয়া নিয়া গরমের মধ্যে লাইনেও দাঁড়াইতে হইতো না।
চার ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবি’র ট্রাক থেকে চাল, ডাল, তেল কিনেছেন নাসিমা খাতুন। পিয়াজ শেষ হওয়ার কারণে তা কিনতে না পেরে আক্ষেপও রয়েছে তার। বলেন, পিয়াজ শেষ হয়ে গেছে। এতক্ষণ দাঁড়াইয়াও পিয়াজ নিতে পারলাম না। সকাল থেকে না খেয়ে বসে আছি। রোদে মাথাব্যথা করছিল। দুইবার মাথায় পানি দিছি। বাজারে এককেজি তেল কিনতে দুইশ’ টাকা লাগে। কাল কোথাও তেল পাই নাই। খোলা তেল কেউ বেচেও না। কাল রাতে তেল ছাড়া রান্না করেছি। আগের মতো দাম কমাই দিলে তো লাইনে দাঁড়াইয়া কষ্ট করে কেনা লাগতো না। নাসিমার স্বামীর হার্টে সমস্যা। কোনো কাজ করতে পারেন না। অন্যের বাড়িতে কাজ করে অল্প কিছু আয় করেন। তা দিয়ে মানবেতর জীবন পার করছে পরিবারটি। নাসিমা বলেন, চাল, ডাল, তেল সবকিছুর দাম বাড়ছে। কিন্তু আমাগো তো কামের দাম বাড়ে না। আমরা কীভাবে সংসার চালাবো।
দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে শুধু দুই কেজি ডাল আর দুই কেজি চিনি কিনতে পেরেছেন জাহানারা বেগম। তেল আর পিয়াজ অনেক আগেই শেষ। তাই এগুলো কিনতে না পেরে জাহানারাও জানালেন তার আক্ষেপের কথা। বলেন, সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে তেল আর পিয়াজ নিতে পারলাম না। যদি এক বোতল তেল পাইতাম তাও এক সপ্তাহ খাইতে পারতাম। ট্রাকের থেকে কম দামে নিয়া কোনো লাভ হয় না। সবাই সব পণ্য নিতে পারে না। শুধু ডাল আর চিনি দিয়া কি হইবো।
পৃথিবীতে কেউ নেই হালিমা আক্তারের। ভিক্ষাবৃত্তি করে দুই বেলা খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছেন। টিসিবি’র পণ্য নিতে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনিও। শেষ পর্যন্ত কোনো পণ্য না পেয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে তিনি বলেন, তিন ঘণ্টা রোদে দাঁড়াইয়া পরানডা ধড়ফড় ধড়ফড় করতাছে। কিন্তু কিছুই নিতে পারলাম না। অনেক কষ্ট লাগতাছে। লাইনে দাঁড়ানোর জন্য ভিক্ষা করতেও যাই নাই আইজ। কাল কি খামু আল্লাহ জানে।
টিসিবি ট্রাক থেকে ক্রেতাদের ২২০ টাকায় দুই লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল, ১১০ টাকায় দুই কেজি চিনি, ১৫০ টাকায় পাঁচ কেজি পিয়াজ ও ১৩০ টাকায় দুই কেজি মসুর ডাল দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এই চারটি পণ্য একসঙ্গে ক্রেতারা ৬১০ টাকায় কিনতে পারছেন। এদিকে এই একই পরিমাণ পণ্য খুচরা বাজারে কিনতে ক্রেতাদের ৪০০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। তাই ছিন্নমূল মানুষের একমাত্র ভরসা এখন টিসিবি। মধ্যবিত্তরাও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস কমাতে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। চক্ষু লজ্জার কারণে অনেকে ছোট বাচ্চাকে লাইনে দাঁড় করাচ্ছেন। বোরকা পরেও লাইনে দাঁড়াচ্ছেন অনেক নারী। কিছু টাকা সাশ্রয় করতে ভিড়ের মধ্যেও চার-পাঁচ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। অনেক দিনমজুর কাজে না গিয়েও টিসিবি’র লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। কিন্তু চাহিদার তুলনায় পণ্য কম থাকায় তাদেরকে খালি হাতেও ফিরতে হচ্ছে।
টিসিবি জানায়, সোমবার রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে ১৪৮টি স্থানে টিসিবি’র পণ্য সরবরাহ করা হয়েছে। প্রতিটি ট্রাকে ২৫০ পরিবারের জন্য ৫০০ কেজি ডাল, ৫০০ লিটার তেল, ৫০০ কেজি চিনি আর ১০০০ কেজি পিয়াজ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সমানুপাতেই প্রত্যেক ট্রাকে এসব পণ্য দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বিক্রির শেষ দিকে এসে কিছু পণ্যের সংকট দেখা যায়। তাই যেসব ক্রেতারা পণ্য নিতে আসেন তারা এক সঙ্গে সবগুলো পণ্য নিতে পারছেন না। এ ব্যাপারে বিক্রেতারা বলছেন, স্থানীয় কিছু মানুষ অনেক সময় তাদের থেকে পণ্য নিয়ে যান। এতে তাদের ব্যবস্থাপনায় কিছুটা বিঘ্ন ঘটে। এ জন্য এমন সংকট দেখা যায়।