পেট ও পিঠ কোনোটাই তো রক্ষা পাচ্ছে না
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৫০:৩১,অপরাহ্ন ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
টিসিবির পণ্য বিক্রির ট্রাক চলে যাচ্ছে। গাড়ির পেছনে মানুষ দৌড়াচ্ছেন। বেশ কয়েকজন আবার ওই ট্রাকের পেছনে ঝুলেও আছেন নাছোড়বান্দার মতো। এক বোতল তেলের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ চলছে টিসিবির আরেকটি ট্রাক ঘিরে। বিক্রয়কর্মী কার হাতে তুলে দেবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। একবার এর হাতে দেবেন তো আরেকবার ওর হাতে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। স্বল্প মূল্যে পণ্য বিক্রির টিসিবির ট্রাক ঘিরে শহুরে গরিবদের এমন দৌড়াদৌড়ি বা হুড়োহুড়ির দৃশ্যে গত কয়েক দিনের সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সয়লাব। টিসিবির ট্রাকের পেছনে ক্রেতাদের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সকালে বিক্রি শুরু করলেও ১২টার মধ্যেই সব পণ্য বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এরপরও ক্রেতাদের লাইন শেষ হয় না।
কিন্তু মধ্যম আয়ের শ্রেণিতে উন্নীত হওয়া মাথাপিছু আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া দেশে এ ধরনের দৃশ্য অস্বস্তিকর। খরা, বন্যা বা কোনো ধরনের দুর্যোগ পরিস্থিতি ব্যতিরেকে স্বাভাবিক অবস্থায় এমন দৃশ্য বিরল ঘটনা। বরং এ ধরনের ঘটনা জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করে। মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে। ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং গাড়ির পেছন পেছন দৌড়ে যাওয়া ভালো কোনো লক্ষণ নয়। সময় ভেদে ক্রেতার সারি দীর্ঘ হতে পারে। কিন্তু পণ্য না পাওয়া অবধি ঝুলে থাকা বা গাড়ি আসা মাত্রই হুমড়ি খেয়ে গাড়ির দিকে যাওয়া, দ্রুত পণ্য শেষ হয়ে যাওয়া অর্থনীতির দুরবস্থার ইঙ্গিত দেয়।
এ থেকে বোঝা যায়, আয় ও উন্নয়নের নানা গল্প শোনানো হলেও সাধারণ নাগরিকেরা ভালো নেই। উন্নয়ন সূচকগুলোর উর্ধ্বগামিতা পরিসংখ্যানগতভাবে প্রদর্শন করে ফাঁপা উন্নয়নের গল্প প্রচার করা হলেও সাধারণ মানুষ এর ভাগীদার হতে পারছে অল্পই।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি হাঁসফাঁস করছে। ‘গরিব সংকটে, মধ্যবিত্ত দুর্দশায়’, ‘সংসার চালানোই দায়’, ‘৫০ হাজার টাকায়ও সংসার চলে না’, ‘সংসার চালাতে দিশেহারা মানুষ,’—এগুলো গত কয়েক সপ্তাহে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রধান শিরোনাম। বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে পরিবহনভাড়া, খাদ্যপণ্য সবকিছুরই দাম বেড়েছে গত এক দশকে অস্বাভাবিকভাবে। দাম এতটাই বেড়েছে যে অবস্থাসম্পন্ন মানুষও এখন সরকারি গাড়ির সামনে লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, ভালো পোশাক পরা মানুষদেরও এখন টিসিবির গাড়ির সামনে লাইনে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে।
‘গরিব সংকটে, মধ্যবিত্ত দুর্দশায়’
পণ্যের ঊর্ধ্বগতির রেখা মোটামুটি ভয়াবহ। কিন্তু এ বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ছিটাফোঁটা ধরনের বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যে থেকেই সমালোচনা করছে। দেশের নামজাদা জাঁদরেল সব বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও থিঙ্কট্যাংকগুলো রহস্যময় কারণে অনেকটা মুখে তালা মেরে আছে। মূল্যস্ফীতির অবস্থা নিয়ে তাঁদের কোনো বক্তব্য নেই। পরিসংখ্যান ব্যুরো জানাচ্ছে, কয়েক মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। তবে কেউ কেউ মনে করছেন, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সম্ভবত জাতীয় মজুরি সূচক ও মূল্যস্ফীতি একই বিন্দুতে এসে মিল গেছে। স্বাভাবিক সময়ে এই দুই সূচকের মধ্যে ১ শতাংশ পার্থক্য থাকে।
কিছু কিছু পণ্য বা সেবার দাম গত এক দশকের তুলনায় ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ২০১০ সালে বিদ্যুতের মূল্য ছিল ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৭৬ পয়সা। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭ টাকা ১৩ পয়সা। এই সময়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৯০ শতাংশ। গ্যাসের দাম বেড়েছে আরও বেশি ১৪৪ শতাংশ। ২০০৯ সালে দুই চুলার দাম ছিল ৪০০ টাকা। ২০২১ সালে হয়েছে ৯৭৫ টাকা। এলপি গ্যাসের দাম ২০২০ সালে ছিল ৮৯১ টাকা। এখন ১ হাজার ১৭৮ টাকা। ২০০৮ সালে পানির দাম ছিল প্রতি ইউনিট ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। ২০২১ সালে হয়েছে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। ২০০৮ সালের তুলনায় দাম বেড়েছে ২৬৪ শতাংশ।