সিলেট বিএনপি : চুপসে গেছেন ‘গ্রুপ’ নেতারা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১:৩১ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরু:
মীরাবাজার গ্রুপ। সাপ্লাই গ্রুপ। পুরান লেন গ্রুপ। মীরবক্সটুলা গ্রুপ। সিলেটে ছাত্রদলের একেকটা গ্রুপের নাম। নগরজুড়েই রয়েছে এখনো হাঁকডাক। বলা হয়ে থাকে; ছাত্রদলের অভ্যন্তরের একেকটি শক্তিশালী ইউনিট। বহু বিতর্ক এসব গ্রুপকে নিয়ে।
লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের নজিরও রয়েছে অনেক। নাক ছিটকানোর মতো কর্মকাণ্ডও ঘটে এসব বলয়ে। এরপরও বলয়কে ঘিরে উৎসাহের অন্ত নেই। ডাক দিলে রাজপথ কাঁপিয়ে তোলেন নেতারা। কর্মীও আসে হাজার হাজার। কিন্তু সাম্প্রতিক বিএনপি’র রাজনীতিতে ভালো নেই গ্রুপ নেতারা। সাইড লাইনে রাখা হয় তাদের। অথচ সিলেটে বিএনপি’র রাজনীতির শক্তির অন্যতম উৎস এই গ্রুপ রাজনীতি। এক যুগের বেশি সময় ক্ষমতায় নেই বিএনপি। সিলেট বিএনপিতে এখন গ্রুপ রাজনীতি নিভু নিভু অবস্থায়। তবে গত এক দশকে বিরোধী রাজনীতির মাঠে লড়াই করতে গিয়ে ধাপে ধাপে মামলার আসামি হয়েছেন এসব গ্রুপ নেতারা। কেউ কেউ ৩০ থেকে ৩৫টি মামলার আসামি হয়ে ফেরারি জীবন কাটিয়েছেন। মামলা, আদালত, কারাগারের ঘানি টেনে টেনে এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। বিএনপি থেকে অনেককেই করা হয় না মূল্যায়ন। অভিমান করে কেউ কেউ চুপসে গেছেন। সিলেট বিএনপিতে গ্রুপিং রাজনীতি শুরু দুই দশকের অধিক সময় থেকে।
সময়টা ১৯৯৩ সাল। সিলেট ছাত্রদলের কমিটি গঠন নিয়ে হঠাৎ করেই বিভক্তি। এই বিভক্তিতে জড়িয়ে পড়েন সিলেটের পরিচিত সাবেক ছাত্রনেতারা। ওই সময় বিভক্ত হয় মূলত দুটি গ্রুপে। এক গ্রুপের ছিলেন বদরুজ্জামান সেলিম ও মিজানুর রহমান মিজান এবং অন্য গ্রুপে ছিলেন সামসুজ্জামান জামান ও আজমল বক্ত সাদেক। এই গ্রুপ বিভক্তির মধ্যে জেলা ছাত্রদলের কমিটি গঠন করা হয়। সেই থেকে শুরু সিলেট ছাত্রদলের গ্রুপিং রাজনীতি। এতে বিভক্ত হয়ে পড়েন বিএনপি, যুবদলসহ অঙ্গ-সংগঠনের নেতারাও। নিজেদের মধ্যে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তাব নিয়ে তাদের মধ্যে রাজপথে লড়াই হয়েছে। এমনকি গুলির লড়াইও হয়েছে। খুনোখুনিতে মেতে উঠেছেন গ্রুপের নেতাকর্মীরা। আর এসবই হয়েছে আধিপত্য নিয়ে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও সিলেট ছাত্রদলের গ্রুপ নেতারা ছিলেন সক্রিয়। ১৯৯৯ সাল থেকে বিবদমান দুই গ্রুপের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করণ বিরোধী আন্দোলনের পর থেকে এই ভাঙন তীব্র হয়। সাপ্লাই গ্রুপটি ছিল সেলিম-মিজান গ্রুপ নামে পরিচিত। সেলিম বিএনপিতে সক্রিয় হয়ে যাওয়ার পর সিলেট জেলা ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি মিজানুর রহমান মিজান একই গ্রুপ পরিচালনা করেন। ওই গ্রুপ তখন ভাঙনের মুখে পড়ে একটি মীরবক্সটুলা গ্রুপ ও আরেকটি পুরাতন সাপ্লাই গ্রুপ রয়ে যায়। ওই গ্রুপের নতুন নেতা হয়ে উঠেন কামরুল হাসান শাহীন। তবে এক সময় সমছু-তপু আবার জুবেরও ওই গ্রুপের নেতৃত্ব দেন। তবে সাপ্লাই গ্রুপের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে কামরুল হাসান শাহীনের নাম।
আর বিএনপিতে সক্রিয় হলে মিজানুর রহমান মিজানের নেতৃত্বেই চলে মীরবক্সটুলা গ্রুপের কার্যক্রম। পরে অবশ্য সেই নেতৃত্ব জিয়াউল গনি আরেফিন জিল্লুরের হাতে চলে আসে। মিজানুর রহমান মিজান এখন বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সদস্য। সুনামগঞ্জের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়েছেন। জিয়াউল গনি আরেফিন জিল্লুর বিএনপি’র এখন ফ্রন্টলাইনের নেতা হলেও দলের গুরুত্বপূর্ণ পদবি তার ভাগ্যে এখনো জুটেনি। কিংবা গ্রুপের অন্য কেউ এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে পারেননি। আর কামরুল হাসান শাহীন এখনো রয়েছেন সাইড লাইনে। নানা তকমায় বিশেষায়িত করে তাকে আড়ালে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। সাপ্লাই গ্রুপের নেতা হওয়ার কারণে এখনো অনেক ছাত্রদল নেতার বড় ভাই হিসেবে পরিচিত কামরুল হাসান শাহীন। গ্রুপ রাজনীতির দরুণ নানা তকমায় বিশেষায়িত হওয়ার কারণে এক সময় চুপসে গিয়েছিলেন কামরুল হাসান শাহীন। মামলা, পলাতক, আদালত এবং কারাগারের ঘানি টানতে হয়ে তার। বর্তমানে ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন শাহীন। নতুন করে শুরু করার তাগিদ থেকে তিনি সক্রিয় হয়ে উঠেছেন বলে তার বলয়ের নেতারা জানিয়েছেন।
সিলেট বিএনপির রাজনীতির পরিচিত নাম মীরাবাজার গ্রুপ। সেটি একক নিয়ন্ত্রক ছিলেন এডভোকেট সামসুজ্জামান জামান। এখনো তার হাতেই রয়েছে ওই বলয়ের নিয়ন্ত্রণ। ১৯৯৯ সালের দিকে মীরাবাজার বলয়েও ভাঙন হয়। নতুন গ্রুপ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে জিন্দাবাজারের পুরান লেন বলয়। ওই বলয়ের নেতা হন আজমল বক্ত সাদেক। এছাড়া নজিবুর রহমান নজিব, মইনুদ্দিন সোহেল, এমরান আহমদ চৌধুরী ছিলেন বলয়ের নেতা। কখনো কখনো এই বলয়কে বলা হতো সাদেক-নজিব- সোহেল-এমরান গ্রুপ। বলয় ভাঙলেও শক্তি ক্ষয় হয়নি মীরাবাজার গ্রুপের। বরং নগরের পূর্ব অংশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হতো মীরাবাজার থেকেই। সেখানে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি ও সরকারী কলেজ এবং পরবর্তীতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এসে যুক্ত হয়। গ্রুপ নেতা এডভোকেট জামান মাঠের শক্তিতে দাপট দেখিয়েছেন সব সময়। ওয়ান ইলেভেনের সময় থেকে মীরাবাজার বলয়ে ভাঙন অব্যাহত থাকে। আর বর্তমান সরকারের প্রথম দিকে এসে আন্দোলনকালে মামলার পর মামলায় বিপর্যস্থ হন ওই বলয়ের নেতারা। এমনকি বলয়ের শীর্ষ নেতা জামানের ওপর প্রায় ৩৫টি মামলা হয়। দীর্ঘদিন ফেরারি জীবন কাটিয়েছেন জামান। বর্তমানে তিনি মুক্ত হলেও অভিমান করে রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসেন। আইনপেশায় সক্রিয় হয়েছেন। সিলেটে স্বেচ্ছাসেবক দলের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে সদলবলে জামান বিএনপির রাজনীতি থেকে নিজ থেকে সরে যান। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় ক্ষুদ্র ও ঋণ বিষয়ক সম্পাদক। এখন মীরাবাজার বলয়ের নেতারা ‘সলিসিটারি মুভমেন্ট’ নামে সামাজিক সংগঠনের কর্মকাণ্ড নিয়ে সক্রিয় রয়েছেন। পুরানলেন বা জিন্দাবাজার বলয়ও সিলেট ছাত্রদলের একটি শক্তিশালী গ্রুপ। সাবেক ছাত্রদল নেতা ও মহানগর বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আজমল বক্ত সাদেক এই গ্রুপের নেতৃত্ব দিতেন। এজন্য অনেক সময় গ্রুপকে বলা হতো সাদেক গ্রুপও। সিলেটের রাজনীতিতে সাদেকের রয়েছে আধিপত্য। কিন্তু গেল ক’বছর ধরে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় সাদেক। প্রায় সময় প্রবাসে থাকেন।
শেষদিকে অবশ্য তাকে মহানগর বিএনপি’র আহ্বায়ক বিএনপি যুগ্ম আহ্বায়ক পদে রাখা হয়েছে। তার বদলে নজিবুর রহমান নজিব এখন হাল ধরেছেন। দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতি থেকে নির্বাসিত ছিলেন নজিব। এবার তার ভাগ্য খুলেছে। মহানগর যুবদলের আহ্বায়কের পাশাপাশি তিনিও মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হয়েছেন। পুরান লেন বলয় থেকে মহানগর যুবদলের সদস্য সচিব হয়েছেন নেওয়াজ বক্ত তারেকও। ফলে পুরান লেনই নিয়ন্ত্রণ করছে মহানগর যুবদলকে। দীর্ঘদিন নানা তকমা লাগিয়ে বলয় নেতাদের নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল জানিয়েছেন গ্রুপের নেতারা। এখন ধীরে ধীরে নেতারা সক্রিয় হচ্ছেন। তবে বলয়ের অনেক নেতাকে পদ-পদবির প্রলোভন দেখিয়ে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। যেমনটি হয়েছে মীরাবাজার গ্রুপে। ওই গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল স্বেচ্ছাসেবক দলের রাজনীতি। কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বে সর্বশেষ বছরখানেক আগে গ্রুপের মধ্যে কম্পন শুরু হয় এবং ভাঙন দেখা দেয়। সিলেট বিএনপির গ্রুপ নেতারা জানিয়েছেন; এখন যারা বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা কোনো কোনো গ্রুপের হয়ে রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত হন।
এরপর রাজনীতির পরিক্রমায় এখন বিএনপির হাল ধরছেন। দুর্দিনে দলের প্রয়োজনে গ্রুপ নেতারা কর্মী নিয়ে মাঠে নামেন। আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা রাখেন। কিন্তু রাজনীতির মূল ফরম্যাটে তারা যেন বেমানান। অনেক সময় গ্রুপের শীর্ষ নেতাদের পাশ কাটিয়ে গ্রুপের অন্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়। এতে করে দলের মধ্যে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। আর এর জন্য দায়ী সিনিয়র অনেক নেতা। তারা গ্রুপ নেতাদের ‘দুর্বৃত্ত’ আখ্যায়িত করে নিজেদের ফায়দা হাসিল করতে চায় এবং করেও। এ কারণে ধীরে ধীরে সিলেট বিএনপির বিভিন্ন গ্রুপের নেতারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ রাজনীতি থেকে দূরে সরে আছেন।