অনলাইনে ফাঁদ ব্ল্যাকমেইলের শিকার নারী
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:৩১ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
রুমানা নিশা। দুই বছর আগে ফেসবুকে পরিচয় হয় নোমানের সঙ্গে। গড়ে ওঠে সম্পর্ক। একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়া। বছর ঘুরতেই নিশা জানতে পারেন নোমানের এমন একাধিক সম্পর্ক রয়েছে। এই নিয়ে শুরু হয় মনোমালিন্য। নোমান সবাইকে ছেড়ে নিশার সঙ্গেই থাকবে- এমন প্রতিশ্রুতি দেয়। নিশা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালো নোমানের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া তার ছবিগুলো। নোমান সেগুলোকে পুঁজি করে নিশাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে। ভয়ে নিশা সেইসব ছবি ডিলিট করতে অনুরোধ করেন। নোমান শেষবারের মতো দেখা করতে বলে নিশাকে। দেখা করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হন নিশা। তখন বিবস্ত্র ছবি ও ভিডিও ধারণ করে রাখে নোমান। ঘটনার দুইদিন পর নিশা ঘুম থেকে উঠে দেখতে পান একটি ফেসবুক আইডি থেকে তার নামে বাজে কথা ও ছবি পোস্ট করা হয়েছে। একই আইডি থেকে আত্মীয়-স্বজনের ইনবক্সেও পাঠানো হয়েছে অন্তরঙ্গ ছবি ও ভিডিও। শেষমেশ নিশা আশ্রয় নেন আইনের।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এভাবে ফাঁদে পড়ে ঘরে ঘরে বহু নারী-পুরুষ এমন দুর্ভোগ আর যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। অনলাইনে এমন নিগৃহের ঘটনা একটি ব্যাধির মতো সংক্রমিত হচ্ছে। পুলিশের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ফেসবুকে ঘনিষ্ঠতা, অন্তরঙ্গ ছবি শেয়ারিংয়ে বাড়ছে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি, আপত্তিকর ভিডিও পাঠানো হচ্ছে। আজেবাজে মেসেজ পাঠানো বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি আপলোড করা হলে পরে সেগুলোকে সফটওয়্যারের মাধ্যমে অশ্লীল ছবিতে রূপান্তর করে হয়রানির শিকার করা হচ্ছে। পুলিশের এই সেলে ভুক্তভোগীর ছবি বা তথ্য ব্যবহার করে বেনামে আইডি খুলে ছবি, ভিডিও বা তথ্য প্রচার বা মেসেজ করা ফেইক আইডি সংশ্লিষ্ট অভিযোগ এসেছে ৬৩৭৫, আইডি হ্যাকের অভিযোগ ১৫৫৪টি, পূর্ব পরিচয় বা সম্পর্কের জের ধরে ছবি, ভিডিও বা তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে সুবিধা বা টাকা দাবি করে ব্ল্যাকমেইলের সংখ্যা ২২৩৫টি, মোবাইলে হ্যারেসমেন্টের অভিযোগ ১৬৬৬টি, বিভিন্ন মাধ্যমে আপত্তিকর কন্টেন্ট পাঠানোর অভিযোগ ১২১৯টি। এ ছাড়া অন্যান্য অভিযোগ ১৬৬৪টি। এ পর্যন্ত সর্বমোট অভিযোগের সংখ্যা ১৪৭১৩। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্টরা জানান, এমন প্রতারণার শিকার হয়ে অনেক নারী লোকলজ্জায় আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নিচ্ছেন। আবার অনেকেই সমাজে নানাভাবে অপমান-অপদস্থ হচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ভুক্তভোগী নারীরা এসব বিষয়ে প্রায়ই অভিযোগ করছেন। অভিযোগের সূত্র ধরে তারা এ ধরনের প্রতারকদের আইনের আওতায় আনছেন।
চলতি বছরের ৬ই ফেব্রুয়ারি ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে নারীর ছবি এডিট করে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা দাবির অভিযোগে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিশোরগঞ্জ মডেল থানা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতের নাম শান্ত পাল (২০)। সে কিশোরগঞ্জ সদরের বত্রিশ এলাকার বাসিন্দা। পুলিশ জানিয়েছে, ভুক্তভোগী নারী ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’-এর ফেসবুক পেজে সাইবার স্পেসে হয়রানির অভিযোগ করেন। অভিযোগে তিনি জানান, প্রায় এক বছর আগে তার একটি ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়ে যায়। হ্যাক হওয়া সেই আইডি থেকে হ্যাকার ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে তা আপত্তিকর ছবির সঙ্গে এডিট করে তার বর্তমান ফেসবুক আইডিতে পাঠায়। ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে তার কাছে ৫০ হাজার টাকাও দাবি করে। ভুক্তভোগী নারীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণ পর্যালোচনা করা হয় এবং প্রযুক্তিগত অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ওই নারীর করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত শান্ত পালকে গ্রেপ্তার করা হয়। শান্তর ব্যবহৃত মোবাইলে ভুক্তভোগীর এডিট করা ছবিসহ ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও অন্যান্য আলামত পাওয়া যায়।
সায়মা একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। তিনি হঠাৎ দেখতে পান যে, একটি ফেসবুক আইডি থেকে তাকে মেসেজ করা হয়েছে। প্রথমে তিনি তার ছাত্র ভেবে রেসপনস করেন। এরপর সেই আইডি থেকে তার এডিট করা আপত্তিকর ছবি পাঠানো হয়। এবং বিভিন্ন গ্রুপে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি করা হয়। টাকা পাঠানোর জন্য তাকে ঢাকার একটি দোকানের বিকাশ নম্বর দেয়া হয়। সায়মা ভয় পেয়ে ২ হাজার টাকা প্রেরণ করেন। এবং ওইদিনই থানায় একটি জিডি করেন। থানা থেকে তাকে পুলিশ সাইবার ফর উইমেন পেইজে অভিযোগ করতে বলা হয়। সায়মার অভিযোগের ভিত্তিতে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে অভিযুক্তকে শনাক্ত করা হয়। অভিযুক্তের বাড়ি সায়মার পাশের গ্রামে। ভুক্তভোগীর করা মামলার প্রেক্ষিতে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মুবিন নামে এক ব্যক্তির ফেসবুক মেসেঞ্জারে কিছু মেসেজ আসে। মুবিন দেখে তার বড় বোন মুনিয়ার ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও পাঠানো হয়েছে। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা নিয়ে মুবিন কি করবে ভাবছে। ততক্ষণে তাদের আরও কিছু আত্মীয় ও বন্ধুর কাছেও একই মেসেজ পৌঁছে যায়। মুনিয়ার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় মো. ইফতেখার জয়ের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে একসময় স্বামীর বাড়ি থেকে চলে আসেন মুনিয়া। পরবর্তীতে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটলে ইফতেখারকে তালাক প্রদান করেন। তালাকের নোটিশ পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে ইফতেখার। মুনিয়ার নামে খোলা আইডি ও আরও কিছু আইডি থেকে তাদের বৈবাহিক সম্পর্কে থাকাকালীন ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও পাঠাতে থাকেন মুনিয়ার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের কাছে। দিশাহারা মুনিয়া ছোট ভাইয়ের পরামর্শে যোগাযোগ করেন পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন এর সঙ্গে। তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু হয়। মুনিয়া পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে মামলা দায়ের করেন। প্রযুক্তির সহযোগিতায় আসামির অবস্থান অনুসন্ধান করে রাজশাহীর বাঘমারা থেকে ইফতেখার জয়কে গ্রেপ্তার করে সংশ্লিষ্ট ইউনিট। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরে তালাক দিয়েও সম্পর্কের কালোছায়া থেকে মুক্তি পাচ্ছিল না মুনিয়া। অবশেষে আসামি গ্রেপ্তারের পরে প্রশান্তির ছায়া এলো মুনিয়ার পরিবারে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীরা বিভিন্ন রকম হয়রানির শিকার হচ্ছে। এই রকম খবর প্রতিনিয়ত পাওয়া যাচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে আমাদের আইজিপি মহোদয় নারীদের জন্য একেবারে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে যেন এই ধরনের সাইবার বুলিংয়ের মতো অপরাধ না ঘটে এবং সে জিনিসগুলোকে নারীরাই যেন নারীদের সহায়তা দিতে পারে সেজন্য পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন নামে পুলিশ সদর দপ্তরে একটি ডেস্ক খুলেছেন। এটা চালু হওয়ার পর থেকেই বেশ সাড়া পেয়েছি বা ভুক্তভোগীরা সমাধান পেয়েছেন। এটার পাশাপাশিও আমাদের পুলিশের সিআইডিতে সাইবার ইউনিট আছে। ভুক্তভোগীরা যেন ভয় না পেয়ে আমাদের কাছে সমস্যার কথা জানায়। আমি মনে করি পুলিশ ছাড়াও স্টেক হোল্ডারদের এগিয়ে আসা উচিত। এখানে গণমাধ্যমকর্মীদেরও অনেক দায়বদ্ধতা আছে।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, দেশে সাইবার বুলিংয়ের পেছনে দুইটি উদ্দেশ্যে থাকে। একটি হলো অনেকদিন ধরে সম্পর্ক ছিল, কোনো ভুল বোঝাবুঝির জন্য সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে। তখন ক্ষোভ থেকে ও কষ্ট দেয়ার জন্য এই কাজগুলো ঘটে থাকে। একই সঙ্গে ব্যক্তিকে সম্মানহানি করা, সমাজের চোখে ছোট করা। আরেকটি হলো- প্রতারক চক্ররা অল্প দিনে সম্পর্ক তৈরি করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। সাইবার বুলিংয়ে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি শিকার হচ্ছে। এই ধরনের ছবি প্রকাশ হলে সমাজের চোখে একজন পুরুষের চেয়ে নারীকে বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়।
ডিবি’র সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার শরিফুল ইসলাম বলেন, ব্যক্তিগত আইডিকে সুরক্ষিত করতে হবে। নিজেদের আইডি সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব কিন্তু নিজের। প্রোফাইল লক করা, অথেনটিকেশন দেয়া, কয়েকটি ট্রাস্টেট কন্ট্রাক দেয়া এই বিষয়গুলো ঠিক করতে হবে আগে। আইডিতে প্রবেশ করে কেউ যেন ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি চুরি করতে না পারে। পরিচিত বন্ধু-বান্ধব কিন্তু এই কাজগুলো কখনই করে না। যারা করে তারা হলো তৃতীয় ব্যক্তি। তিনি বলেন, যারা এই ধরনের হয়রানির শিকার হবেন তাদেরকে আমরা আইনি সহযোগিতা করবো। আমাদের কাছে এলে জিডি করার মতো হলে জিডি করে দিচ্ছি। আবার এমনও অনেক ঘটনা আছে যেগুলোর মামলা করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তানিয়া রহমান বলেন, আমরা যত বৈজ্ঞানিক সুবিধা গ্রহণ করবো তার পজেটিভ কিছুর পাশাপাশি নেগেটিভ কিছু থাকবেই। বিভিন্ন সুবিধা ভোগের পাশাপাশি অসুবিধা যেগুলো তার একটি হলো সাইবার বুলিং। সাইবার বুলিংয়ের ঘটনায় নিজে শেষ হয়ে যাওয়া কোনো সমাধান নয়। এটি অনেক বেশি হচ্ছে। এই অপরাধগুলো বন্ধ হওয়া দরকার। বন্ধ না করে আমরা নিজেরা যদি আত্মাহুতি দেই এটাতো কোনো সমাধান না। আমি যদি এই ধরনের কোনো কর্ম করেও থাকি সেটা আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা। সমাজ এবং আইনের দৃষ্টিতে আমি যদি অপরাধী না হই এবং আমার বিরুদ্ধে যারা এগুলো বলবে আমি বরং তাদের বিরুদ্ধে লড়বো।
পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সার্ভিসের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খালেদা বেগম বলেন, অনেক কিশোর-কিশোরী এই ঘটনার ভুক্তভোগী হয়। ভুক্তভোগী নারীরা অনেক সময় এমন কি তাদের পরিবারকেও জানাতে চান না। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশা ও অর্থনৈতিক-সামাজিক অবস্থানের নারীরা যোগাযোগ করছেন। অনেকেই চমৎকারভাবে নিজের সমস্যা জানাচ্ছেন। অনেক সময় সাধারণ পরামর্শ নিয়ে নিজেই নিজের সমস্যা সমাধান করে ফেলছেন। আবার সেই একই সমস্যা অনেকে সহজে সমাধান করতে পারছেন না। তাদের সাইবার ইউনিটের কর্মকর্তারা ধৈর্যের সঙ্গে সমস্যাটির সমাধানে সহযোগিতা করার চেষ্টা করছেন। যথেষ্ট তথ্যাদির অভাবে কারও কারও ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে কিছুটা সময় লাগছে। এ ছাড়া যে সব ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, ঘটনার প্রেক্ষিতে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সে সব আইনি পদক্ষেপের ব্যাপারে পরামর্শ দিচ্ছে। এতে অনেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পথ খুঁজে পাচ্ছে। তিনি বলেন, এই ধরনের ঘটনা শুধু যে মেয়েদের ক্ষেত্রে ঘটছে সেটি নয়, ছেলেদেরও অভিযোগ আসে। যেগুলো আমাদের কর্ম পরিধির মধ্যে পড়ে সেগুলো দেখা হয়। পুরুষদের ফিরিয়ে দেয়া হয় না, তাদের পরামর্শ দিয়ে যেখান থেকে সহযোগিতা নিতে পারবে সেখানে পাঠানো হয়।