স্বামীকে বাঁচাতে বিদেশবিভুঁইয়ে ছুটে এলেন স্ত্রী!
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
হিন্দু শাস্ত্রে আঠারটি পুরাণ রয়েছে। পদ্মপুরাণ হচ্ছে তন্মধ্যে একটি। এই পুরাণের প্রধান দেবতা সর্পদেবী মনসা। আর পদ্মপুরাণ-এর মূল উপজীব্য চাঁদ সওদাগরের ওপর দেবী মনসার অত্যাচার, চাঁদের পুত্র লখিন্দরের সর্পাঘাতে মৃত্যু ও পুত্রবধূ বেহুলার আত্মত্যাগের উপাখ্যান। যেখানে মনসার পাঠানো একটি সাপ লখিন্দরকে হত্যা করে। প্রচলিত প্রথা অনুসারে লখিন্দরকে কলাগাছের ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু বেহুলা সবার বাধা অগ্রাহ্য করে তার মৃত স্বামীর সঙ্গে ভেলায় চড়ে বসে। তারা ছয় মাস ধরে যাত্রা করে এবং গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিতে থাকে।
এই অবস্থায় মৃতদেহ পচে যেতে শুরু করে এবং গ্রামবাসীরা তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন মনে করতে থাকে। বেহুলা মনসার কাছে প্রার্থনা অব্যাহত রাখে। ভেলা ভাসতে ভাসতে মনসার সহচরী নেতার ঘাটে এসে ভিড়ে। বেহুলার প্রার্থনা শুনে নেতা তাকে মনসার কাছে নিয়ে যান। তখন মনসা বললেন, তুমি লখিন্দরকে ফিরে পাবে, যদি তুমি তোমার শ্বশুরকে আমার পূজারী করতে পারো। বেহুলা তার শাশুড়িকে সব ঘটনা বর্ণনা করলেন। বেহুলা তার শাশুড়ির সহযোগিতায় চাঁদ সওদাগরকে মনসার উপাসনা করতে সম্মত হন। চাঁদের পক্ষে আর না বলা সম্ভব হয় না। তারপর মনসার অলৌকিক ক্ষমতাবলে লখিন্দরের ক্ষয়ে যাওয়া মাংস ফিরে আসে এবং চোখ মেলে তাকান। এরপর লখিন্দর বেহুলার দিকে তাকিয়ে হাসে। ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে চোখের পলকে বেহুলা ও মৃত লখিন্দরকে মর্ত্যে পৌঁছে দেন। যুগে যুগে এ ঘটনা ছোট বড় সবার জানা। হয়তো বেহুলার মতো এখন আর কারও স্বামীকে বাঁচাতে ভেলায় ভেসে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিতে হয় না। তবে স্বামীকে বাঁচাতে উড়োজাহাজে চড়ে পারস্য সাগর পাড়ি দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসেছেন এই সময়ের স্বামীভক্ত আরেক বেহুলা রেখা রানী শীল।
জানা যায়, ২০০৭ সালে জীবিকার তাগিদে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন অর্জুন শীল। প্রবাসে ছয় বছর যাবৎ কিডনিজনিত ব্যাধির চিকিৎসা করছিলেন তিনি। তাও বিদেশবিভুঁইয়ে- সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি খলিফা হাসপাতালে। কিন্তু বিধিবাম অনেক চিকিৎসার পরও কিছুতেই ভালো হচ্ছিল না তার শরীর। দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে! এ কথা জানার পর তার মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ে।
অর্জুন শীল (৪৬)কে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তার স্ত্রী রেখা রানী শীল। দেশ থেকে যোগাযোগ করেন দুবাইয়ের চিকিৎসকদের সঙ্গে। বলেন, স্বামীকে তিনিই কিডনি দেবেন। কিন্তু রক্তের গ্রুপে মিল না থাকায় হতাশাচ্ছন্ন হতে হয় তাকে। তবে রেখা রানীর আকুলতায় বিকল্প পথ খুঁজতে থাকেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকরা। একসময় বিকল্প পথ খুঁজেও পান হাসপাতালের চিকিৎসকরা। তারা জানান, রেখা রানী তার কিডনি দান করলে সেটির বিনিময়ে তারা অর্জুন শীলের উপযোগী অন্য একটি কিডনির ব্যবস্থা করে দেবেন। এর ফলে শুধু অর্জুন শীল নন, আরও একজন কিডনি রোগী বেঁচে থাকার সুযোগ পাবেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান ফেনী সদর উপজেলার রেখা রানী শীল। দ্রুত রওনা হন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিকে। জীবন, অর্থ আর অহমিকার মায়া ত্যাগ করে বর্তমানে তিনি দেশটির রাজধানী আবুধাবিতে স্বামীর সঙ্গে রয়েছেন।
১৯৯৯ সালে ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের অর্জুন শীলের সঙ্গে বিয়ে হয় একই উপজেলার মজলিশপুরের রেখা রানী শীলের। পরে জীবিকার তাগিদে অর্জুন শীল ২০০৭ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাড়ি জমান। আবুধাবিতে একটি সেলুন দোকান পরিচালনা করতেন তিনি। শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিলে আবুধাবির শেখ খলিফা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৯ সালে অর্জুন জানতে পারেন, তার একটি কিডনি বিকল হয়ে গেছে। কয়েক বছরের মধ্যে তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটে এবং চিকিৎসকরা জানান, তার অন্য কিডনিও নষ্ট হয়ে গেছে। এ অবস্থায় তাকে বাঁচাতে গত ১লা ফেব্রুয়ারি আবুধাবিতে ছুটে আসেন রেখা রানী শীল।
এ প্রসঙ্গে রেখা রানী শীল বলেন, ‘স্বামীই আমার সব। সে বাঁচলেই আমি বাঁচি। আজ সে কঠিন অসুস্থ। কিন্তু তাকে বাঁচতেই হবে। তিনটি মেয়ে নিয়ে আমাদের সংসার। আমাদের জন্য তাকে বাঁচাতে আমি সবার সহযোগিতা ও আশীর্বাদ চাই।’