অবৈধ পথে ইউরোপ : দীর্ঘ হচ্ছে সিলেটের তরুণদের মৃত্যুর মিছিল
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৪০:৫৭,অপরাহ্ন ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
বিদেশ বিভুঁইয়ে দীর্ঘ হচ্ছে সিলেটের তরুণদের লাশের মিছিল। কেউ মারা যাচ্ছেন অবৈধপন্থায় স্বপ্নের ইউরোপ যাত্রার পথে। আবার কেউ মারা যাচ্ছেন বিদেশের মাটিতে সন্ত্রাসী হামলা ও দুর্ঘটনার শিকার হয়ে। গেল দুই বছরে সাগরে ডুবে, পুলিশের গুলিতে, সন্ত্রাসী হামলা ও দুর্ঘটনায় সিলেটের শতাধিক যুবক মারা গেছেন। সম্প্রতি তুরস্ক ও গ্রিসের সীমান্তে ঠান্ডায় মারা গেছেন অভিবাসী প্রত্যাশী সিলেটের দুই যুবক। এর আগে গত একমাসে মারা গেছেন আরও অন্তত ১০ জন।
প্রবাসী অধ্যুষিত হওয়ায় সিলেট বিভাগের তরুণদের মাঝে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেশি। বৈধ উপায়ে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ না পেয়ে তারা হাত ধরেন দালালের। দালালের সাথে চুক্তি করে বিভিন্ন দেশ ঘুরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা পাড়ি দিতে চান ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এসময় দালালদের দ্বারা প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকারও হন তারা। দালালরা বিদেশে নিয়ে জিম্মি করে দেশে থাকা স্বজনদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে তুলে দেয় বিভিন্ন দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে। আর যখন কেউ পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে কারাগারে যায়, তখন পরিবারের সাথে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এরপর থেকে ইউরোপ যাওয়ার জন্য ঘরছাড়া তরুণটি বেঁচে আছে না মারা গেছে তারও কোন খোঁজ পান না পরিবারের সদস্যরা। ইউরোপে পাঠানোর জন্য বিভিন্ন দেশ ঘুরিয়ে দালালরা অনেককে লিবিয়ায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে নৌকা করে ভ‚মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যেতে হয় ইতালীসহ বিভিন্ন দেশে। সাগর পাড়ি দেয়ার সময় সলিল সমাধি হয় অনেকের। গত মাসের শেষের দিকে ইতালী যাওয়ার উদ্দেশ্যে দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় যাওয়া বিয়ানীবাজারের খশির আবদুল্লাহপুর শাহজিপাড়ার আমিনুল ইসলাম নামের এক যুবক সেদেশের পুলিশের গুলিতে মারা যান। লিবিয়ার কারাগারে বিয়ানীবাজারের আরও ২৪ জন যুবক বন্দি রয়েছে বলে জানিয়েছেন তাদের স্বজনরা।
সর্বশেষ গত ২ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক ও গ্রিস সীমান্তে অভিভাসনপ্রত্যাশী ১২ জন ঠান্ডায় মারা যান। এর মধ্যে ছিলেন সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জের দু’জন। একজন দিরাই উপজেলার সাকিতপুর গ্রামের জনি সর্দার ও অপরজন হচ্ছেন দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া গ্রামের বাসিন্দা। তুরস্ক হয়ে তারা গ্রিসে ঢুকার চেষ্টা করছিলেন। এর আগে ২০২০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর একইভাবে তুরস্ক থেকে গ্রিস যাওয়ার পথে দুই সিলেটী যুবকের মৃত্যু হয়। তারা হলেন- ওসমানীনগর উপজেলার মনোহর আলীর ছেলে মো. আক্তার আহমেদ ও সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার আসিদুর রহমানের ছেলে মিজানুর রহমান।
অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার সময় মারা যাওয়ার ঘটনা ছাড়াও বিদেশে দুর্ঘটনা, খুন ও আত্মহত্যার মতোও ঘটনা ঘটছে। বিদেশে যাওয়া মারা যাওয়া যুবকদের পরিবারের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, অনেকে যে স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ যান, সেখানে দিয়ে সে স্বপ্ন পূরণ হয় না। দেশে যে যুবক কোন কাজই করেনি, বিদেশ গিয়ে তাকে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়। অনেককে ঝুঁকিপূর্ণ অনেক কাজও করতে হচ্ছে। কিন্তু দেশে থাকা স্বজনদের মুখের দিকে চেয়ে তারা ফিরেও আসতে পারেন না। ফলে দিনের পর দিন শারীরিক ও মানসিক কষ্টে ভোগে অনেকে হতাশায় ভ‚গেন। এ থেকে দুর্ঘটনাও ঘটছে। এছাড়া বিদেশে বর্ণবাদ ও সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েও অনেকে প্রাণ হারাচ্ছেন।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলসাইন্দ পীরেরচক গ্রামের বাসিন্দা জুবেল আহমদ। এর আগের দিন ৩ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার নর্দান কেপ প্রদেশের আফিংটন এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান সিলেট নগরীর কুশিঘাট এলাকার আলাওর রহমানের ছেলে আকবর হোসেন। জুবেল ও আকবরের পরিবারে এখন শোকের মাতম চলছে। গত বছরের ৫ মে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ সংলগ্ন আলবার্টন থেকে আরমান মিয়া নামের এক যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়। আরমানের মৃত্যু রহস্য এখনো রয়ে গেছে অজানা। গত ৩০ জানুয়ারি দুবাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান কুলাউড়ার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের গণকিয়া গ্রামের ইসমাইল আলীর ছেলে আশরাফ আলী। দুবাই যাওয়ার ১৫ দিনের মাথায় তিনি মারা যান।
গত বছরজুড়ে দেশের বাইরে সিলেটের বেশ কয়েকজন যুবকের অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গত বছরের ১৪ আগস্ট রাতে কুয়েতের আবদালি এলাকায় একটি কৃষি খামারের ‘লেবারশেডে’ আগুন লেগে সিলেটের তিন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। গত বছরের ৩১ অক্টোবর রাতে সৌদি আরবের রিয়াদে একটি বহুতল ভবন থেকে পড়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বর্ণি গ্রামের মো. আলী হোসেন নামের এক শ্রমিক মারা যান। ওই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি সৌদিআরবের দাম্মামে লিফট ছিড়ে মারা যান গোয়াইনঘাট উপজেলার নবমখন্ড গ্রামের যুবক মো. শাহীন খান। গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর স্কটল্যান্ডে সহকর্মীর ছুরিকাঘাতে খুন হন বিয়ানীবাজার উপজেলার ফতেহপুর গ্রামের সেলিম উদ্দিন নামের এক যুবক।