পুলিশ আতঙ্কে পুরুষশূন্য গ্রাম, মানবেতর জীবনযাপন নারীদের
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ জানুয়ারি ২০২২, ১১:৫৩ অপরাহ্ণ
তিনদিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত শিশু মাহবুবুর রহমান (২)। শিশুটিকে কোলে নিয়ে শুধু কাঁদছেন মা আলফা বেগম। অথচ একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবা বেঁচে থেকেও পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারছেন না। নির্বাচনী সহিংসতার কোনো ঘটনায় জড়িত না থেকেও পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার ৫ নম্বর ভিমখালী ইউনিয়নের ছেলাইয়া গ্রামের আমির হোসেন স্ত্রী আলফা বেগমের সঙ্গে কথা বলে এতথ্য জানা গেছে। শুধু আলফা বেগমের পরিবার নয়, পুলিশ আতঙ্কে শত শত পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বুধবার (৫ জানুয়ারি) জামালগঞ্জ উপজেলার চারটি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোটগ্রহণ শেষে ৫ নম্বর ভিমখালী ইউনিয়নের মুহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গণনা চলছিল। এসময় দুই ইউপি মেম্বার পদপ্রার্থী জুয়েল মিয়া (ফুটবল) ও বাবুল মিয়া (মোরগ) প্রতীকের সমর্থকরা কেন্দ্রের সামনে অবস্থান করছিলেন। এক পর্যায়ে মোরগ প্রতীকের এক এজেন্ট কেন্দ্র থেকে বের হয়ে ঘোষণা দেন বিপুল ভোটে মোরগ প্রতীক বিজয়ী হয়েছে। তারা বিজয় মিছিলও বের করেন। তবে গণনা শেষে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ফুটবল প্রতীককে বিজয়ী ঘোষণা করেন। এতে মোরগ প্রতীকের সর্মথকরা কেন্দ্রের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
ভোট বাক্স জামালগঞ্জ উপজেলা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মোরগ প্রতীকের সর্মথকরা পুলিশের ওপর হামলা চালান। এতে পাঁচ পুলিশ ও চারজন আনসার সদস্য গুরুতর আহত হন। আহতদের জামালগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে সেখানে আরেক দফা হামলা চালানো হয়। পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে ১০ রাউন্ড গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি শান্ত করে এবং ২০ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতপরিচয় ২০০ জন আসামি করে মামলা করে।
মামলার পর থেকে পুলিশি আতঙ্কে ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের লালপুর বাজারের ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের কারেন্টের বাজারের সব দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। দুই গ্রামীণ বাজারের প্রায় পাঁচ শতাধিক দোকানপাট বন্ধ থাকায় আট গ্রামের মানুষের আসা-যাওয়া ও বেচাকেনা বন্ধ রয়েছে।
ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের লালবাজার এলাকায় মুহাম্মদপুর, ছেলাইয়া ও মানিগাঁও গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। ২ নম্বর ওয়ার্ডের কারেন্টের বাজার এলাকায় ফেকুল মুহাম্মদপুর, চান্দেরনগর, তেরানগর, রাজাপুর গ্রামের মানুষও পুলিশি আতঙ্কে আছেন।
সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, ভিমখালী ইউনিয়নের ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচনের সহিংসতার পর থেকে পুলিশের ভয়ে গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ বাজারের সব ধরনের দোকানপাট। ফলে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন গ্রামের নারী ও শিশুরা। রাতে না ঘুমিয়ে গরু-ছাগল পাহারা দিচ্ছেন নারীরা। পুরুষশূন্য হওয়ায় গ্রামে চুরি বেড়েছে।
মুহাম্মদপুর গ্রামের বাসিন্দা জুবায়ের হোসেন সুমন জাগো নিউজকে বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে আমরা বাড়িতে যেতে পারছি না। সবাই পুলিশের ভয়ে আছি। আমরা চাই যারা ঘটনায় জড়িত পুলিশ তাদের খুঁজে বের করে গ্রেফতার করুক।
সাফিয়া বেগম বলেন, ‘ঘরে রান্না করার মতো কিছু নেই। আমার স্বামীও পলাতক। এজন্য নিজেই বাজার করতে এসেছি। কিন্তু বাজারে এসে একটা দোকানও খোলা পাইনি। এখন বাসায় ফিরে ছেলেমেয়েদের কী খেতে দেবো?’
লালপুর বাজারের দোকানদার তহিদুল ইসলাম বাচ্চু জাগো নিউজকে বলেন, ‘দোষ না করেও আজ চোরের মতো পালিয়ে বাঁচতে হচ্ছে। আমার মা খুব অসুস্থ কিন্তু কাছ থেকে তার সেবা করতে পারছি না। ওষুধ কেনারও টাকা নেই। কেননা তিনদিন হলো পুলিশের ভয়ে দোকান খুলতে পারিনি। মাকেও চোরের মতো লুকিয়ে গিয়ে দেখতে হয়।
ছেলাইয়া গ্রামের বাসিন্দা সামিয়া বেগম জানালেন, বাড়িঘরে পুরুষ মানুষ নেই। এজন্য আমরা চুরি-ডাকাতির ভয়ে আছি। সারারাত না ঘুমিয়ে গরু, ছাগল পাহারা দিতে হচ্ছে।
একই গ্রামের বাসিন্দা খাদিজা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আজ তিনদিন হলো স্বামী বাড়িতে নেই। ছেলেমেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে আছি। একবেলা খেলে দুই বেলা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। আমরা এই কষ্ট থেকে মুক্তি চাই।’
জানতে চাইলে জামালগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মো. আব্দুন নাসের জাগো নিউজকে বলেন, গ্রামের মানুষ পুলিশের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলছে তা সঠিক নয়। আমরা কারো ওপর নির্যাতন করিনি। সিসি ক্যামোরার ফুটেজ দেখে আসামিদের গ্রেফতার করা হবে। এতে সাধারণ মানুষের ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।
তিনি আরও বলেন, আমি গ্রামের মানুষদের বলেছি নিশ্চিন্তে দোকান খুলতে কিন্তু তারা ভয়ে দোকান খুলছে না। আমি গ্রামের মানুষের সঙ্গে একটি সভা করে তাদের ভয় দূর করবো।