সুনামগঞ্জে পাথর খোয়ারি থেকে চলছে নিরব চাঁদাবাজি
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জানুয়ারি ২০২২, ৩:৪৮ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
অবৈধভাবে উত্তেলিত পাথর বাজেয়াপ্ত করে নিলামে বিক্রয় করেছিলো টাস্কফোর্স। এরপর থেকেই যেনো নদীতে অঘোষিত পাথর উত্তোলনের বৈধতা পেয়ে যায় প্রভাবশালী ব্যাবসায়ি চক্র। এখানেই শেষ নয়। আলোচনা রয়েছে পাথর পরিবহনের যন্ত্র চালিত বাহন থেকে চাঁদা আদায় ঘিরেও।
টাস্কফোর্সের বেধে দেয়া সময়সীমা অনুযায়ি গেলো বছরের ৭ ডিসেম্বর থেকে চলতি মাসের ১৭ তারিখ অব্দি সময়ের মধ্যে নিলামকৃত সকল পাথর সরিয়ে নিতে হবে উল্লেখ করে ক্ষমতাপত্র জারি করা হয়। পাশাপাশি কেবলমাত্র নিলামকৃত পাথর পরিবহন করতে দেওয়া হলেও ক্ষমতাপত্রের দোহাই দিয়ে নদী থেকে নতুনভাবে পাথর উত্তোলন করছে চক্রটি। পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ের নাম করে এগুলো পরিবহন করার সুবিধা করে দিয়ে চাঁদাবাজিও চলছে দেদারসে। এ যেনো নদী থেকে অবাধে পাথর উত্তোলনের এক রকম বৈধতা। টাস্কফোর্সের জব্দকৃত ও নিলামের পাথর সরিয়ে নেয়া শেষ হয়ে গেলেও বর্তমানে প্রতিদিনই প্রায় দেড় শতাধিক ট্রাকযোগে রাতের মধ্যবর্তী সময় থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত নদী থেকে উত্তোলন করে স্তুপ করে রাখা পাথর পরিবহন হচ্ছে। সরকারি রাজস্বের কথা বলে প্রতি ট্রাক থেকে ৭শ করে টাকা আদায়ও করা হচ্ছে।
সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়নের নিকটবর্তী ধোপাজান চলতি নদীতে চলছে এমন সুনামগঞ্জে রাজস্ব আদায়ের নামে সিন্ডিকেটের চাঁদাবাজি। এমন অনিয়মকে অনেকটা দেখেও না দেখার ভান করছেন স্থানীয় দেখভালের দায়িত্বে থাকা দায়িত্বশীলরা। স্থানীয়রা বলছেন একটি চক্র তাদের ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য নানা মহলে টাকা দিয়েই চালাচ্ছেন এমন বাণিজ্য। তবে স্থানীয়ভাবে প্রভাব থাকায় কেউই এই চক্রের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পান না। এ অবস্থায় পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি অবৈধ পন্থায় পাথর উত্তোলনে বিপুল পরিমানে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
অভিযোগ রয়েছে, অনিয়মের এমন অবস্থা দিনে দুপুরে চললেও এসব বন্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ি বলেন, সরকারি ভাবে নদীতে পাথর উত্তোলন বন্ধ করার জন্য অভিযান চালিয়ে লুকিয়ে তোলা পাথর জব্দ করা হয়েছিলো, বলা হয়েছে দ্রæত নিলাম করে এখান থেকে পাথরগুলো সরিয়ে নিতে, কিন্তু জব্দকরা পাথর ১০ দিনের মধ্যেই দিনে-রাতে সরিয়ে নিয়ে নদী থেকে নতুন করে হাজার হাজার শ্রমিক দিয়ে পাথর উত্তোলন করিয়ে এগুলো বিক্রি করা হচ্ছে, যা দেখার কেউ নেই।
অভিযোগের সত্যতা জানতে সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গেলে এসময় দেখা যায়, ধোপাজান চলতি নদীর দুই তীরের এলাকা জুড়ে হাজার হাজার শ্রমিক সনাতন পদ্ধতিতে উত্তোলন করছেন পাথর। উত্তোলনকৃত এসব পাথর নদীর পূর্ব পাড়ে স্তুপ করে রাখছেন শ্রমিকরা। অনেকেই সাথে সাথে ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহনে তুলে দিচ্ছেন। পাথরের স্তুপ কিংবা পরিবহণের পাশে থাকা লোকের কাছ থেকে পাথরের টুকরি প্রতি নিচ্ছেন কূপন । কূপনের রহস্য জানতে চাইলে শ্রমিকরা জানান প্রতি ক‚পনের বিপরীতে ৪০ টাকা পাচ্ছেন তারা। এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধান করলে জানা যায়, শ্রমিকদের কাছ থেকে এসব পাথর ক্রয় করছে স্থানীয় একটি ব্যবসায়ি চক্র। ব্যবসায়িরা এই পাথর সড়ক পথে নেয়ার সময় নির্দিষ্ট স্থানে রাজস্বের নামে টুকেন দিয়ে পাথরের ফুট প্রতি ৫৬ টাকা আদায় করছে কে বা কারা।
টোল আদায়ের অস্থায়ি ঐ ঘরে গেলে বেরিয়ে আসে টাকা আদায়ের আসল রহস্য। টাস্কফোর্সের মাধ্যমে জব্ধকৃত মালামাল নীলামে সরিয়ে নেয়ার ক্ষমতাপত্রের মালিকই পরিবহণ থেকে আদায় করছেন এই নিয়মিত চাঁদা। চাঁদা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে টোল ঘরে থাকা ক্ষমতাপত্রের স্থানীয় ইউপি সদস্য মালেক জানান, নিলামের পাথর সরিয়ে নেয়ার সময় নাকি পাথরের হিসেব রাখতে এমন টুকেন ও টাকার লেনদেন হচ্ছে। আর পরিবহণে নেয়া এসব পাথরও নাকি টাস্কফোর্সের নিলামকৃত পাথর।
ক্ষমতাপত্রের মালিক আব্দুল মালিকের কথার সত্যতা মিলাতে আবারও নদীর পাড়ে যান অনুসন্ধানী প্রতিবেদক। সেখানে গিয়ে শ্রমিক ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে ও পারের হালচিত্র দেখে এটা নিশ্চিত হয় যে- টাস্কফোর্সের নিলামকৃত কোনো পাথর নদীর পাড়ে নেই। যা ছিলো তা অনেক আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব পাথর নতুন করে নদীতে থেকে বেশ কিছুদিন ধরেই তুলে বিক্রি করছেন শ্রমিকরা।
ধোপাজান চলতি নদীর এমন অবস্থায় টাস্কফোর্সের অভিযানের পর নিলামকৃত পাথরের ক্ষমতাপত্র দেখা জরুরী। পরিবশে অধিদপ্তর সিলেট এর সহকারি পরিচালক মো. আলমগীর ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইমরান শাহারিয়ার স্বাক্ষরিত ক্ষমতাপত্রে লেখা রয়েছে, “ডলুরা ধোপাজান (চলতি নদী) হতে অবৈধভাবে উত্তোলন করে স্তুপকৃত ৯৩ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়।
উক্ত জব্দকৃত পাথর তাৎক্ষনিকভাবে ডলুরা বর্ডারহাট নামক স্থানে নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। নিলামে অংশগ্রহণ করেন জনাব মো. আব্দুল মালেক। প্রতি ঘনফুট ৪৮ টাকা দরে ৪৪ লক্ষ ৬৪ হাজার টাকা যার ১০% হারে ভ্যাট ২ লক্ষ ২৩ হাজার ২০০ টাকা ৫% হারে আয়কসহ মোট ৫১ লক্ষ ৩৩ হাজার ৬০০ টাকা ৭ কার্য দিবসের মধ্যে নির্ধারিত কোর্ডে জমাপ্রদান সাপেক্ষ উত্ত পাথর স্থানান্তরের ক্ষমতা অর্পন করা হলো।” ক্ষমতাপত্রে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ” উত্ত নিলামকৃত পাথর ১৭ জানুয়ারি ২০২২ এর মধ্যে সরানোর নির্দেশ প্রদান করা হলো।
নদীতে পাথর উত্তোলন ও জব্দকৃত পাথরের ক্ষমতাপত্রের সম্পর্কে জানতে চাইলে টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান শাহারিয়ার বলেন, “জব্দকৃত পাথর যা নিলাম দেয়া হয়েছিল সেইগুলো ব্যতিত নদী থেকে নতুন পাথর উত্তোলনের কোনো বৈধতা নেই। ক্ষমতাপত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ পাথর সরিয়ে নেয়ার নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। প্রতিদিন কতটুকু পাথর বের হয়েছে তার হিসেব বিজিবি রাখবে। নির্দিষ্ট পরিমাণ পাথর নেয়ার পর নতুনভাবে পাথর সরানোর কোনো উপায় নেই।
রাজস্ব আদায় বা চাঁদা তুলার ব্যাপারে তিনি বলেন, তারা পাথর ক্রয় করেছে। রাজস্বের নাম করে পরিবহন থেকে চাঁদা আদায় করা অবশ্যই আইন বর্হিভূত।
এদিকে নিলামকৃত পাথরের হিসেব রাখাটা বিজিবির দায়িত্ব নয় বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ ২৮ বডার গার্ড ব্যাটেলিয়ানের অধিনায়ক লে.কর্নেল মাহবুর আলম । তবে নদীতে পাথর উত্তোলনের বিষয়টি খোঁজ নিবেন বলে জানান তিনি।
নতুন করে পাথর উত্তোলন ও চাঁদার ব্যাপারে টাস্কফোর্স কর্র্র্তৃক ক্ষমতাপত্রের মালিক মো. আব্দুল মালেক মুঠোফোনে জানান জব্দকৃত নিলামের পাথর নাকি তাদের ছিল। তারা এগুলো শ্রমিকদের কাছ থেকে কিনেছেন। তবে টাস্কফোর্স কমিটি তাদের এই ক্রয় করা পাথরই জব্দ করে। নিলামে অংশ নিয়ে জব্দকৃত পাথর পুনরায় ক্রয় করেন তারা। তাই নিজেদের পাথরের হিসেব রাখতে টোকেন এর মাধ্যমে হিসেব রাখেন তিনি। ভিডিও ফুটেজে টাকা আদায়ের চিত্র দেখা গেলেও তিনি টাকা আদায়ের বিষয়টি অস্কীকার করেন। নতুন করে শ্রমিকদের কাছ থেকে পাথর ক্রয়ে সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন গরীব মানুষরা নদী থেকে পাথর তুলে আমরা তাদের কাছ থেকে ক্রয় করি।