সিলেটে আ’লীগে দ্বন্দ্বের ফায়দা নিচ্ছে জামায়াত
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:২৬ অপরাহ্ণ
গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ও গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্বের কারণে এখানে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে জামায়াত। দ্বন্দ্বের কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও জামায়াতকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন- এমন অভিযোগ রয়েছে।
বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলা নিয়ে সিলেট-৬ সংসদীয় আসন। টানা তিন মেয়াদে এই আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ। গত দুই মেয়াদে শিক্ষামন্ত্রীও ছিলেন তিনি।
সংসদ নির্বাচনগুলোর ভোটের হিসাব সাক্ষ্য দেয়, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জে আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান রয়েছে। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র।
সদ্যসমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এই দুই এলাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের ভরাডুবি ঘটেছে।
গত রোববার সিলেটের এই দুই উপজেলার ২০টি ইউনিয়নে ভোটগ্রহণ হয়। এর মধ্যে মাত্র সাতটিতে নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। বাকি ১৩ ইউপির মধ্যে তিনটিতে জামানত হারিয়েছেন নৌকার প্রার্থী। অন্যদিকে চারটি ইউনিয়নে জয়ী হয়েছেন জামায়াতের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা।
চলমান ইউপি নির্বাচনে আগের তিন দফায় এতসংখ্যক জামায়াত নেতা সিলেটের কোথাও বিজয়ী হতে পারেননি।
অনেক ইউনিয়নে জামায়াতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়তে পারেননি আওয়ামী লীগের প্রার্থী। গোলাপগঞ্জের ঢাকা দক্ষিণ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন জামায়াত নেতা এম আব্দুর রহিম। এ ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী নজরুল ইসলাম ৪৭৮ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন।
দীর্ঘদিন ধরেই দেশের রাজনীতিতে কোণঠাসা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী। প্রকাশ্যে তেমন কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রমও নেই। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারিয়ে দল হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগও হারিয়েছে দলটি। এমন পরিস্থিতিতে কী করে চারটি ইউনিয়নে জয়ী হলেন জামায়াত নেতারা?
গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ও গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্বের কারণে এখানে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে জামায়াত। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও জামায়াতকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন- এমন অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় অনেকে বলছেন, প্রকাশ্যে তেমন কোনো তৎপরতা না থাকলেও গ্রামগঞ্জে নানা কৌশলে সংগঠিত হচ্ছে জামায়াত। অন্য দলগুলোর রাজনৈতিব কার্যক্রম খুব একটা না থাকার সুযোগে তৃণমূলে শক্তি সঞ্চয় করছে ধর্মভিত্তিক দলটি।
ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের থামাতে না পারার খেসারতও আওয়ামী লীগকে দিতে হয়েছে বলে মনে করেন তারা।
তবে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান ইউপি নির্বাচনের এই ফলকে সন্তোষজনক বলেই মনে করেন।
তিনি বলেন, ‘২০টি ইউনিয়নের মধ্যে সাতটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং পাঁচটিতে বিদ্রোহীরা জয়ী হয়েছেন। সে হিসাবে ১২টি ইউপিতেই কিন্তু আমাদের লোকেরা জিতেছেন।
‘যেসব ইউনিয়নে জামায়াত প্রার্থীরা জিতেছেন সেগুলোয় ‘এন্টি-আওয়ামী ভোট’ সব এক হয়ে গিয়েছিল। বিএনপিসহ প্রতিক্রিয়াশীল সব ভোট তারা পেয়েছে। ফলে এককভাবে জামায়াত জিতেছে এটা বলা যাবে না।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব
গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরেই একাধিক ভাগে বিভক্ত। স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) নুরুল ইসলাম নাহিদ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীও ছিলেন। টানা তিন মেয়াদের এমপিও তিনি। তবে এলাকায় তার অবস্থান অনেকটাই নড়বড়ে।
নাহিদ মন্ত্রী থাকার সময়েই গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার আওয়ামী লীগে বিভক্তি দেখা দেয়। গত সংসদ নির্বাচনেও এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন কানাডা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সিলেটের প্রভাবশালী নেতা সারোয়ার হোসেন।
এই এলাকায় আওয়ামী লীগ নাহিদ ও সারোয়ার গ্রুপে বিভক্ত। এ ছাড়া আছে উপদলীয় কোন্দল। বিয়ানীবাজার উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আবুল কাশেম পল্লব নাহিদ বিরোধী বলয়ের নেতা হিসেবে পরিচিত। গোলাপগঞ্জেও রয়েছে এমন উপদলীয় কোন্দল। ইউপি নির্বাচনে এই কোন্দলের প্রভাব পড়েছে।
গোলাপগঞ্জের এক স্কুলশিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখানে আওয়ামী লীগ বহু ধারায় বিভক্ত। নিজেদের গ্রুপ ভারী করতে অনেক নেতা জামায়াতকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকেন। ফলে এই দুই উপজেলা জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠেছে।
গোলাপগঞ্জের লক্ষণাবন্দ ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী ছিলেন আব্দুল করিম খান। নির্বাচনে ২৩ হাজার ভোটের মধ্যে সাকল্যে তিনি পেয়েছেন ১৩৯ ভোট। স্বভাবতই হারিয়েছেন জামানত।
এই শোচনীয় পরাজয়ের জন্য দলের কোন্দলকে দায়ী করে আব্দুল করিম খান বলেন, ‘দলের বেশির ভাগ নেতাকর্মী আমার সঙ্গে ছিল না। যারা ছিল তারা শুধু লোক দেখানোর জন্য ছিল। দলের নেতাকর্মী আমার সঙ্গে থাকলে জয়ী না হলেও সম্মানজনক সংখ্যার ভোট পেতাম।
সিলেট জেলা যুবলীগ নেতা ও গোলাপগঞ্জ আমুড়া এলাকার বাসিন্দা ফজলুর রহমান জসিম বলেন, ‘অনেক জায়গায় দলের বিরোধের কারণেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী হেরেছেন। দুই উপজেলায়ই আওয়ামী লীগে কোন্দল রয়েছে। কিছু ইউনিয়নে প্রার্থী বাছাইয়েও ভুল ছিল।’
গোলাপগঞ্জ আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি লুৎফুর রহমান বলেন, ‘দলীয় প্রতীকে না হলেও উপজেলায় বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীরা তাদের প্রার্থীর পক্ষে ব্যাপক সক্রিয় ছিলেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা দলীয় প্রার্থীর ক্ষতি করেছেন। দলেও বিভক্তি রয়েছে। এসবের প্রভাব পড়েছে ভোটের ফলে।
গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্ব
গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত গোলাপগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী দেয়া হয় পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রুহেল আহমদকে। সেবার দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন এই পৌরসভার সাবেক দুই মেয়র উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া আহমদ ও পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. আমিনুল ইসলাম। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হন তারা। নির্বাচনে হারতে হয় নৌকার প্রার্থীকে
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, গোলাপগঞ্জ আওয়ামী লীগে দলীয় কোন্দলের চেয়েও গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্ব প্রবল। এখানে চৌধুরী, তালকুদার ও কিরান- এই তিন গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব রয়েছে। রাবেল, পাপলু ও রুহেল এই তিন গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর সেই দ্বন্দ্বের জের ধরেই মেয়র পদে প্রার্থী হন তারা তিনজন।
একই ধরনের গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্ব রয়েছে বিয়ানীবাজার উপজেলায়ও। এখানে যেকোনো নির্বাচনেই গোষ্ঠিভিত্তিক দ্বন্দ্ব আরও প্রবল হয়ে ওঠে। এবারের ইউপি নির্বাচনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, নির্বাচন এলেই আওয়ামী লীগের ভোট গোষ্ঠীভিত্তিক ভাগ হয়ে যায়। আর এর সুযোগ নেয় জামায়াত।
সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান বলেন, এই দুই উপজেলায় আঞ্চলিকতা ও গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব প্রবল। আর এই দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়ে ভোটে।
নাসির উদ্দিনেরও বাড়ি বিয়ানীবাজার উপজেলায়। নিজ এলাকার গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করছেন জানিয়ে এ নেতা বলেন, ‘আগের থেকে অনেকটা কমিয়ে এনেছি। তার পরও কিছুটা রয়ে গেছে। আর এখানকার ভোট যতটা আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের লড়াই; তারচেয়েও বেশি গোষ্ঠী ও এলাকাভিত্তিক লড়াই।’
প্রার্থী বাছাইয়ে ‘ভুল’
বিয়ানীবাজারের তিলপাড়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এমাদ উদ্দিন ৯২০ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন। এ ইউনিয়নে ৩ হাজার ৫১৩ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির সাবেক সহসম্পাদক মাহবুবুর রহমান।
তিলপাড়ায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন বিবেকানন্দ দাস। তা না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন তিনি। এই বিদ্রোহী ২ হাজার ৭২৬ ভোট পেয়ে মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলেন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, তৃণমূল থেকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে বিবেকানন্দ দাসের নামই প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে কেন্দ্র থেকে নৌকা দেয়া হয় এমাদ উদ্দিনকে। দুই উপজেলায় তৃণমূলের পছন্দের অন্তত পাঁচ প্রার্থী কেন্দ্রে গিয়ে ছিটকে পড়েন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় নেতারা।
এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড নানা কিছু হিসাব-নিকাশ করেই মনোনয়ন দেয়। দলের প্রতি কার কী অবদান, আগে কেউ বিদ্রোহী হয়েছিলেন কি না- এসব এবার বিবেচনা করা হয়েছে। ফলে তৃণমূলের ভোটে এগিয়ে থেকেও কেউ কেউ দলীয় মনোনয়ন পাননি।
আগে থেকেই জামায়াতের আস্তানা
গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার উপজেলায় দীর্ঘদিন থেকে জামায়াতের শক্ত অবস্থান রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় অনেকে। অন্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোরও ভোট রয়েছে এখানে।
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে এই আসনে জেলা দক্ষিণ জামায়াতের আমির মাওলানা হাবিবুর রহমানকে প্রার্থী করেছিল চারদলীয় জোট। গত নির্বাচনেও ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন তিনি। শেষ মুহূর্তে নানা হিসাব-নিকাশে সেবার মনোনয়ন পাননি হাবিব।
এখানকার ধর্মভিত্তিক গোষ্টীর ভোট টানতে ২০০৬ সালের বাতিল হওয়া নির্বাচনে নুরুল ইসলাম নাহিদের বদলে খেলাফত মজলিশের নেতা প্রয়াত প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমানকে মনোনয়ন দিয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। লেখিকা তসলিমা নাসরিনের মাথার দাম ঘোষণা করে দেশব্যাপী আলোচনায় উঠে এসেছিলেন এই হাবীবুর রহমান।
বিয়ানীবাজারের স্থানীয় এক সাংবাদিক বলেন, উপজেলার মুড়িয়া ইউনিয়নে জামায়াতে ইসলামীর নেতা ফরিদ আল মামুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এ ইউনিয়নে দীর্ঘদিন ধরেই জামায়াত জিতে আসছে।
জেলা যুবলীগ নেতা ফজলুর রহমান জসিম বলেন, এখানকার কিছু এলাকা দীর্ঘদিন ধরেই জামায়াত-বিএনপির দখলে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেও তাদের এই দুর্গ ভাঙতে পারেনি আওয়ামী লীগ। ফলে আগামীতেও এসব ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান বলেন, এখানকার অনেক ইউনিয়নে জামায়াত-বিএনপি আগে থেকেই শক্তিশালী। আমরা তাদের ভোটব্যাংকে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছি।
নিউজ বাংলা