বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ জয়ের গল্প
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা–বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। লাল-সবুজের আজকের এই বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক বিরত্ব দেখিয়েছেন যুদ্ধে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধারা। যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আবার অনেকে ফিরে এসেছেন। জাতি শ্রদ্ধা ভরে আত্বোৎসর্গকারীদের স্মরণ করে। দিন দিন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কমছে। যুদ্ধ শেষে যারা ফিরে এসেছেন সেইসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আংশিক কিছু কথা আমরা তুলে ধরব।
গেরিলা বীর মুক্তিযোদ্ধা নামে পরিচিত আফজাল হোসেন। তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিট কমান্ড ও সাবেক ডেপুটি কমান্ডার। সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বীর দর্পে।
তিনি বলেন, আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের অত্যাচারে বাঙালি জাতি যখন দিশেহারা তখন কান্ডারী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমস্ত জাতি এক হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আমরা অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। ২২ এপ্রিল পর্যন্ত নওগাঁ মুক্ত ছিল। পাঞ্জারিরা ২২শে অক্টোবর তা দখল করে। আমরা পরিবারের মায়া ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। ভারতের ক্যাম্পে প্রশিক্ষণে যোগদান করি। আমাদের ক্যাম্পটা ছিল সম্পূর্ণ ভারতীয় সৈন্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেখানে কর্নেল মজুমদার এর অধীনে রায়গঞ্জে আমরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। ২১ দিন প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের সীমান্তে কিছুদিন যুদ্ধ করতে হয়। তারপরে আমরা বাংলাদেশের ভেতরে চলে আসি।
ধামইরহাট উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার অফির উদ্দিন।
তিনি বলেন, জেলার মান্দা উপজেলার মৈনম ছিল পাঞ্জাবীদের ক্যাম্প। সেখানে আমাদের প্রথম অপারেশন হয়। ৭ নম্বর সেক্টর লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুরুজ্জামান এর অধীনে আমরা ছিলাম। আমাদের গ্রুপে ছিল রাজা ভাই, শিরু ভাই, নারগিস, দুলাল, আলাউদ্দিন ও আলাউদ্দিন মোল্লা সহ ২৫-৩০ জন। মাঠ পর্যায়ে আমাদের নেতা ছিল রাজা ভাই। নওগাঁ জেলাতে ঢুকে পুরোপুরি গেরিলা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে যায়। মৈনম দিয়ে যুদ্ধ শুরু করি। তারপর জেলার রানীনগরের একটি ব্রিজ এক্সেলেটর দিয়ে উড়িয়ে দিয়। সেখানে অন্তত ৫০ জন পাকিস্থানী সৈন্য মারা যায়।
যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, একদিন সকালের নাস্তা করছি। খবর আসে কিছু পাঞ্জাবি জেলার আত্রাইয়ের বান্দাইখাড়ায় পুরুষদের হত্যা করে এবং নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন করে আত্রাইয়ের দিকে নৌকা যোগে যাচ্ছে। তখন আত্রাইয়ের বাউল্লাপাড়া গিয়ে আমার সবাই অবস্থান করি। আমরা প্রায় তিনশতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। তার মধ্যে রাজা ভাই ছিলেন। বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মালেক ভাই ছিলেন। সেদিন যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা সেখানে নয়টা নৌকা আক্রমণ করি। এতে প্রায় ৩০জন পাঞ্জাবি সৈন্য মারা যায়। পরবর্তীতে তারা শক্তি সঞ্চয় করে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে আমরা সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হই।
৭ নম্বর সেক্টেরের অধীনে হিলি থেকে মাহিসন্তোষ এলাকায় যুদ্ধ করেছেন জেলার ধামইরহাট উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার অফির উদ্দিন। তারা একসঙ্গে ২৯ জন যুদ্ধ করেছিলেন।
মান্দা উপজেলা জফরাবাদ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলবর হোসেন।
মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের বাঙ্গালিপুর ক্যাম্পে যাই। আব্দুল জলিল ভাই আমাদের সেখানে রাখবেন না বলে পরদিন মেহেদীপুর নতুন ক্যাম্পে নিয়ে যাই। সেখান থেকে পতিরামপুর নিয়ে যায়। সবশেষে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য শিলিগুড়ি ক্যাম্পে নিয়ে ২৯ দিন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে অপারেশন ক্যাম্প উরমিউল ক্যাম্পে আমাদের স্থানান্তর করে। সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করি।
তিনি বলেন, একদিন মাহিসন্তোষ দূর্গা নামে এক এলাকায় সকাল ১০ টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। সেখানে যুদ্ধে আমার সহযোদ্ধা উপেন, প্রতাপ ও আবু বক্কর শহীদ হয়। আমার কমান্ডার বগুড়ার বাসিন্দা শ্রী নারায়নকে আটক করে নিয়ে যায় পাকবাহিনী। তিনি ভাল হিন্দি বলতে পারতেন। ভারি গোলা বারুদ নিক্ষেপ করা হলে এক সময় পাকবাহিনীরা পেছনে হঠতে বাধ্য হয়। সে যুদ্ধে অনেক পাকবাহিনী মারা পড়ে।
তিনি বলেন, যুদ্ধ শেষে শহীদদের উদ্ধার করে আবু বক্করকে ক্যাম্পের পাশে কবর দেওয়া হয়। আর উপেন ও প্রতাপকে ভারতে শ্মশান নিয়ে মৃতদেহ স্বতকার্য সম্পন্ন করা হয়। এর একমাস পর কমান্ডার শ্রী নারায়ন সুযোগ বুঝে পাকবাহিনীর হাত থেকে পালিয়ে আমাদের ক্যাম্পে ফিরে আসে। ফুলের তোড়া দিয়ে তাকে বরণ করে নেওয়া হয়। সে ফিরে আসার তার ওজন হিসেবে সে পরিমাণ জিলাপি এলাকাবাসীকে খাওয়ানো হয়।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এক সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং বলতে থাকেন গুলি আমারও লাগতে পারতো। সেদিন আল্লাহ নিজ হাতে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
জেলার মান্দা উপজেলা জফরাবাদ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলবর হোসেন। তিনি বলেন, জীবনে ভাবিনি যুদ্ধ শেষে আবার বাড়ি ফিরবো। একটা গুলি লাগলে তো মারা যেতাম। ৭ মার্চ যখন বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিলেন যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ো। রেডিওতে ভাষণ শুনার পর শুক্রকে দেশ থেকে উৎখাত করতে আমরা ১৮ জন ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়। তখন আমার বয়স ১৮ বছরের টগবগে যুবক। ৭ নম্বর সেক্টরের আঞ্চলিক অধিনায়ক ছিলেন রফিকুল ইসলাম। ওই ব্যাচে প্রায় ১২৫০ জন যোদ্ধা ছিল।
যুদ্ধের একটি ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, আমাদের খাবার রান্না করতেন জাফর নামে একজন। তার বাড়ি রানীনগরে। একদিন দুপুরে রান্না প্রায় শেষ। খাওয়া শুরু হবে। এমন একটা চিঠি আসলো যুদ্ধের সংকেত হিসেবে। খাওয়া শেষে যুদ্ধে অংশ নিলাম। তখন জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি থানার আটা পাড়া। যা পূর্বে ছিল বগুড়ার মধ্যে। সেখানে পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে পাক বাহিনীদের আক্রমণ করা শুরু করলাম। পাল্টা তারাও আক্রমণ শুরু করলো। দক্ষিণ দিক ফাঁকা থাকায় তারা পেছনের দিকে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা তাদের ক্যাম্প নওগাঁ শহরের দিকে চলে যায়। সে যুদ্ধে আমাদের কেউ হতাহত না হলেও তাদের অনেকেই মারা গিয়েছিল।
আফসোস করে তিনি বলেন, যারা জীবনে ভারত দেখেনি তারা এখন মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার। আমরা জীবন দিলাম, যুদ্ধ করলাম, দেশ স্বাধীন করলাম কিন্তু কিছুই হতে পারলাম না। সরকার থেকে ভাতাসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি এটাই তো অনেক বড় পাওয়া।