সিলেটে অনেক প্রশ্ন, কী ঘটেছিল সে রাতে
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ ডিসেম্বর ২০২১, ৯:৩৫ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরু:
সিলেটে যে আলোচনার এখনো শেষ হচ্ছে না। জল্পনা চলছেই। সবাই তাকিয়ে আছেন তদন্ত রিপোর্টের দিকে। সেদিন রাতের আদালতপাড়ায় কী ঘটেছিল। আর কোর্ট ইন্সপেক্টর প্রদীপ কেনোই বা কক্ষের লাইট অফ করে রেখেছিলেন। এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিলেটের উপ-পুলিশ কমিশনার সোহেল রেজা। তদন্তের দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য নিচ্ছেন। গতকাল পর্যন্ত প্রায় ১৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন।
এর মধ্যে রয়েছেন ওই দিন দায়িত্বে থাকা কয়েকজন পুলিশ সদস্যও। সিলেটের আদালতপাড়ায় কোর্ট ইন্সপেক্টর প্রদীপ কুমার দাশের কক্ষে ছিলেন ছুটিতে এক নারী কনস্টেবল। লাইট অফ ছিল ইন্সপেক্টর প্রদীপের কক্ষের। এ নিয়ে রাতেই আদালতপাড়ায় তোলপাড় হয়। পরে সহকারী কমিশনার (প্রসিকিউশন) খোকন চন্দ্র সরকার এ নিয়ে ঊর্ধ্বতনদের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে রাতেই ইন্সপেক্টর প্রদীপকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়। এরপর ছুটি বাতিল থেকে ওই নারী কনস্টেবলকে ক্লোজ করা হয়েছে। এখন চলছে তদন্ত। উপ-পুলিশ কমিশনার সোহেল রাজা নিবিড়ভাবে বিষয়টি তদন্ত করছেন। প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের জন্য তিনি কাজ করছেন।
ঘটনা গত ১লা ডিসেম্বর রাতের। ওই দিন আদালতপাড়ায় ওসি প্রদীপ কুমার দাশের কক্ষে গিয়েছিলেন ছুটিতে থাকা মহিলা কনস্টেবল। রাত ৮টার দিকে ওই নারী কনস্টেবল যান। মহিলা কনস্টেবল রুমে যাওয়ার কিছু সময় পর লাইট অফ করে দরোজা ভেতর থেকে আটকে দেয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। কানাঘুষা শুরু হয় আদালতপাড়ায়। ঘটনার পর ইন্সপেক্টর প্রদীপের নির্দেশে কনস্টেবল পীযূষকে নিয়ে ওই নারী কনস্টেবলকে গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দেন। এ সময় দু’জন সাংবাদিকও সেখানে উপস্থিত ছিলেন সাক্ষীদের জবানিতে উঠে এসেছে। আলোচিত এ ঘটনায় পরিদর্শক প্রদীপ ও ওই নারী কনস্টেবলের ন্যায় আরেকটি নামও আলোচনায় এসেছে। তিনি হলেন গোলাপগঞ্জ কোর্টের জিআরও শওকত আলী। মূলত শওকত আলীর তথ্যের ভিত্তিতে ঘটনাস্থলে যান এসএমপি’র সহকারী পুলিশ কমিশনার (প্রসিকিউশন) খোকন চন্দ্র সরকার। তিনি ঘটনার প্রাথমিক সত্যতাও পান। পরবর্তীতে অভিযুক্তদের প্রত্যাহার ও একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু তথ্য প্রদানের কারণে বেকায়দায় রয়েছেন শওকত আলী। একটি পক্ষ তাকে বিতর্কিত করাসহ ঘটনাটি ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ওই দিন ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ঘটনার দিন আদালতপাড়ায় মামলার মাসিক হিসাবনিকাশের শেষ দিন ছিল। রাত প্রায় ৮টার দিকে নারী কনস্টেবল কোর্ট পরিদর্শক প্রদীপের কক্ষে ঢুকেন। তার অবস্থানকালে কক্ষের বাইরে কিছু পুলিশ সদস্য যার যার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। নারী কনস্টেবল কক্ষে প্রবেশের কিছু সময় পর ভেতরের বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়। এমনকি ভেতর থেকে দরজাও লাগিয়ে দেয়া হয়। বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেন বাইরে অবস্থানরত কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তারা কানাঘুষাও শুরু করেন। প্রায় ২০-২৫ মিনিট পর পরিদর্শক প্রদীপ দরজা খুলে বাতি নেভানো অবস্থায় বের হন। বাইরে কয়েক মিনিট পায়চারী করে আবার ভেতরে যান। ওই সময় কনস্টেবল মিলন মামলার নথি আনার জন্য ভেতরে যেতে চাইলে তাকে প্রবেশ করতে দেননি প্রদীপ। দরজার কাছ থেকে নথি নিজেই এসে গ্রহণ করেন।
কনস্টেবল মিলনের জবানবন্দিতেও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। নথি নিয়ে প্রদীপ ভেতরে যাওয়ার পরই বাইরে অবস্থানকারী পুলিশ সদস্যরা কক্ষের ভেতর ‘অনৈতিক কিছু হয়েছে’ বলে ধারণা করেন। ওই সময় জিআরও শওকত এসএমপি’র সহকারী পুলিশ কমিশনার (প্রসিকিউশন) খোকন চন্দ্র সরকারকে ফোনে বিষয়টি অবগত করেন। রাত ৮টা ১৫ মিনিটের দিকে প্রদীপ প্রথমে হাজতের পরিচ্ছন্নকর্মী নুরজাহানকে ডেকে নারী কনস্টেবলকে এগিয়ে দিতে বলেন। কিন্তু নুরজাহান তা করেন নি। উল্টো তিনি নারী পুলিশকে প্রশ্ন করেন- প্রতিদিন একা যান আজ আমি কেন এগিয়ে দেবো। আর রাতেই বা কেন? পরে কনস্টেবল পীযূষকে ডেকে এনে নারী পুলিশকে এগিয়ে দিতে বলেন প্রদীপ। পীযূষ তাকে নিয়ে বের হয়ে কোর্টের প্রধান ফটকের সামনে যাওয়ার পর এসি খোকন চন্দ্র তাদের দাঁড় করান। জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
নারী কনস্টেবল তাকে জানান, তিনি মোবাইল রেখে গিয়েছিলেন। পীযূষকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন ওই নারী পুলিশ। তিনজনের সাক্ষী ও সহকারী পুলিশ কমিশনারের তদন্ত প্রতিবেদন ছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে ঘটনার তথ্য প্রদানকারী এএসআই শওকত, কনস্টেবল মিলন ও পীযূষসহ ১৫ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের জবানবন্দি প্রায় একই ধরনের। এদের মধ্যে এএসআই শওকত সেদিনের পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন। একইভাবে অপর সাক্ষীরাও জবানবন্দি দেন। তবে এখনো সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেনি তদন্ত টিম। এ বিষয়ে শওকত আলী বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার লিখিত জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। কিছু বলতে হলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে। কারও সঙ্গে বিরোধ আছে কিনা-এমন বিষয়ে তিনি জানান, কোনো বিরোধ নেই। কোর্টের কার্যক্রম জেলা ও মেট্রোপুলিশের আলাদা। জানি না কে বা কারা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ফায়দা নিতে চাচ্ছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান এসএমপি’র উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) সোহেল রেজা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ১৫ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। এখনো আরও কয়েকজন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ বাকি আছে। তদন্ত শেষ হলে ৭-৮ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দাখিল করা হবে বলে জানান তিনি।