ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ সিলেট : অর্থাভাবে আটকে আছে ৪২ হাজার ভবনের পরীক্ষা
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ ডিসেম্বর ২০২১, ৯:৫৪ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
সিলেট ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে অনেক আগে থেকেই। ফলে এ অঞ্চলে ভূমিকম্প নিয়ে রয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা; বাড়ছে আতঙ্ক। ১১ মাসের মাথায় ২৩বার ঝাঁকুনি দিয়েছে সিলেটে। এদিকে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অনেক আগে থেকে সিলেট নগরীর ভবনগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য বলা হলেও তা হয়ে উঠেনি। তবে সম্প্রতি নগরীর প্রায় ৪২ হাজার ভবন পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা যাবে কোনটির ভূমিকম্প সহনীয় ক্ষমতা কতটুকু। তবে অর্থাভাবে এখনো সেই পরীক্ষাও আটকে আছে।
সিসিক থেকে বলা হচ্ছে- ৪২ হাজার ভবন থাকলেও কোন ভবণ ভূমিকম্প সহনীয় ক্ষমতা কতটুকু সেই তথ্য নেই তাদের কাছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছোট-বড় ৪৭টি ভূমিকম্পে কেঁপেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ২০১৮ সালে চারবার, ২০১৯সালে সাতবার, ২০২০ সালে ১৫ বার এবং চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ২১ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। গত মাসের ৭ অক্টোবর রাত ১২টা ২৮ মিনিটে ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দেশ। রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৬ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল মিয়ানমারের মানওয়া।
সিলেট নগরীতে ‘বিল্ডিং কোড’ না মেনে ভবন নির্মাণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, বড় ধরণের ভূমিকম্প হলে সিলেট নগরে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে এটা বিশেষজ্ঞরা আগ থেকেই জানিয়ে আসছেন। এজন্য সিসিকের পক্ষ থেকে সরকারি-বেসরকারি বহুতল বিল্ডিংগুলো ‘কোড’ মেনে বহুতল ভবন তৈরির জন্য আমরা মাঝে-মধ্যে নোটিশও দেই।
তিনি বলেন, নগরীতে প্রায় ৪২ হাজার ভবন থাকলেও কোনটির ভূমিকম্প সহনীয় ক্ষমতা কতটুকু তার কোনো তথ্য নেই নগরভবনে। তাই ভবনগুলো পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে জুন মাসে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিক পর্যায়ে সমীক্ষা চালায়। এর পর ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের সাথেও যোগাযোগ করা হয়।ঢাকার ওই প্রতিষ্ঠানটি চারতলা একটা ভবন সার্ভের জন্য ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ফি চায়। সেই হিসেবে সবমিলিয়ে নগরীর ৪০-৪২ হাজার ভবন পরীক্ষা করাতে ২৫-৩০ কোটি টাকার প্রয়োজন। কিন্তু সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এই খাতে এতো বিশাল অংকের টাকা খরচ করার মতো তহবিল নেই। তাই ঢাকার ওই প্রতিষ্ঠানটির সাথে এখনো চুক্তি হয়নি।তবে এখনো আলাপ আলোচনা চলছে।
তিনি বলেন, নিয়মমতো ভবন পরীক্ষার টাকা সংশ্লিষ্ট ভবন মালিকদেরই দেয়ার কথা। কিন্তু কেউই টাকা দিতে রাজি হচ্ছে না। তাই সিটি করপোরেশনকে ‘ধীরে চলো’ নীতি অবলম্বন করতে হচ্ছে।
সিলেট আবহওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেট অঞ্চল হচ্ছে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। সিলেটের উত্তরে রয়েছে ডাউকি ফল্ট ও পূর্বে বার্মিক আর্ক। এ জন্য সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্পের জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁর মতে, শুক্রবারের ভূমিকম্প অদূর ভবিষ্যতে যে বড় আকারের ভূমিকম্প ঘটতে চলেছে তারই সূচক।
তিনি বলেন, সমগ্র মিয়ায়ন রেঞ্জে শুক্রবার রিখটার স্কেলে ২ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৬ মাত্রা পর্যন্ত ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। আর এসব ঘটেছে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে। এটি একটি ‘ইন্ট্রাপ্লেট মুভমেন্ট’- যা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, সমস্ত থ্রাস্ট ফল্ট লাইনগুলো সক্রিয় রয়েছে।
সিলেটে ভূমিকম্প ও নগরীর ভবন নির্মাণ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণা করছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক জহির বিন আলম।
তিনি আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেন, আমরা কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম। সিসিকের সিডিএমডি প্রকল্পের আওতায় জাপান সরকারের সহযোগিতায় কাজ চলছে। নগরীতে মাঝারি থেকে অতিমাত্রার ভূমিকম্পে ৯০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এমন অনেক ভবন মালিককে সিসিক নোটিশ করলেও আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২৯ ও ৩০ মে এবং ৭ জুন ভূমিকম্পে অন্তত ১০ বার কেঁপে ওঠে সিলেট।এসব ভূকম্পনের উৎপত্তিস্থল সিলেটের বিভিন্ন এলাকা।৭ জুনের ভূকম্পনের মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৮। এর আগে ভূকম্পনের মধ্যে সর্বোচ্চ কম্পনের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ১। ঘন ঘন ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে নড়েচড়ে বসে নগর কর্তৃপক্ষ।
নগরীর ১০টি মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করে সিলেট সিটি করপোরেশন। এরপর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশেষজ্ঞ দল ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলো পরিদর্শন করেন। এরপর তারা মার্কেটগুলোর ভূকম্পন সহনীয়তা নির্ণয়ে স্ট্রাকচারাল ম্যাপ ও সয়েল টেস্টের কাগজ চান। কিন্তু একটি ছাড়া অন্য কোন মার্কেট তাদের কাগজ জমা দিতে পারেননি। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলোর ঝুঁকির পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।