জুরাইন কবরস্থান : রাত নামলেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ১:৪৯ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
রাত সাড়ে ১০টা। রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানের পশ্চিম কর্র্নারের দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করলেন তিন যুবক। কবরস্থানের ভেতরে বসে আরও তিন চারজনকে নেশাদ্রব্য সেবন করতে দেখা গেল। তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন ওই তিন যুবকও। আশপাশে তেমন লোকজন না থাকলেও পাশের রাস্তা দিয়ে মাঝে- মধ্যে দুই-চারজন পথচারী গেলেও সেদিকে কারো ভ্রূক্ষেপ নেই। কবরস্থানের দুই গেটে দু’জন পাহারাদার দিচ্ছেন পাহারা। তারপরও ৭ জন নেশাগ্রস্ত লোকজনের অবস্থান দীর্ঘক্ষণ দেখা যায়। শুধু পশ্চিম পাশে নয়, কবরস্থানের চারদিকে ঘুরে উত্তর ও দক্ষিণ দিকেও এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। বুঝতে বাকি রইলো না, রাতের বেলার জুরাইন কবরস্থানের এটিই স্বাভাবিক চিত্র। দিনের বেলা যাই ঘটুক, রাত নামলে এভাবেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। এছাড়াও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এই কবরস্থানের নানা অব্যবস্থাপনার চিত্র উঠে এসেছে মানবজমিন-এর অনুসন্ধানে।
বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে সরজমিন কবরস্থানটিতে দেখা যায়, এর মূল প্রবেশপথেই ময়লা-আবর্জনা দিয়ে ভরা। চারদিকে উৎকট দুর্গন্ধ। নোংরা পরিবেশ। ভেতর-বাহিরে আছে ছোট-বড় ছাগল এবং কুকুরের বিচরণ। কবরের উপরে লাগানো দুর্বা ঘাস খেয়ে কবরের উপরেই মলত্যাগ করছে ছাগলগুলো। অল্প কয়দিন আগেই একটি কুকুর তার ৭-৮টি বাচ্চা প্রসব করেছে কবরের পশ্চিম পাশে। কবরের ওপরেই সেগুলো হাঁটাচলা করছে। কবরস্থানের ভেতরেই খেলাধুলা করে এলাকার ছোট-বড় সবাই। এছাড়া নিয়মিত পরিষ্কার না করায় কবরস্থানের ভেতরে জঙ্গলে রূপ নিয়েছে। সরজমিন দেখা যায়, আসরের নামাজের পর অনেকেই এসেছেন তাদের প্রিয় স্বজনের কবর জিয়ারত করতে। কিন্তু প্রবেশপথ দিয়ে যাওয়াই যেন দুষ্কর। কবরস্থানের ভেতরে অহেতুক বহিরাগতদের চলাফেরা, ভবঘুরে, ভিক্ষুক, নেশাগ্রস্ত ও কবর দেখাশোনা করার নামে বহিরাগতদের দৌরান স্বজনদের কবর জিয়ারতেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া কবর রক্ষাণাবেক্ষণের নামে এখানেও চলে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের প্রতিযোগিতা।
কবর জিয়ারত করতে আসা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকার অন্যান্য কবরস্থানের মতোই এখানেও নিয়মিত টাকা না দিলে কবর অল্পদিনের মধ্যেই হারিয়ে যায়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সেখানে আরেকজনকে দাফন করা হয়। আবার নিয়মিত টাকা দিলে নির্ধারিত সময়ের অনেক পরেও কবর সংরক্ষণ করা যায়। মৃতের স্বজনরা জানান, যে যত বেশি টাকা বা বকশিশ দেয়, তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কবরগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়। আর বাকিগুলো অবহেলায় জরাজীর্ণ করে রাখা হয়। আবার টাকা দিলে সেগুলো মাটি ও দুর্বা দিয়ে সংস্কার করে দেয়া হয়। এছাড়া সিটি করপোরেশন থেকে নির্ধারিত দাফন-কাফনের খরচের চেয়ে বাড়তি খরচ নেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। কবর প্রতি রেজিস্ট্রেশন ফি ১ হাজার টাকা ধরা হলেও ২-৩ হাজার করে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মাস খানেক আগে দাফন করা মায়ের কবর জিয়ারত করছিলেন একটি পরিবারের ৫-৬ জন সদস্য। দোয়া শেষে এই প্রতিবেদকের কাছে তারা বলেন, মাত্র এই কয়েকদিনেই কবর ভেঙে গেছে। চারপাশে ময়লা আবর্জনা দিয়ে ভরা। কবরস্থান হলো পবিত্র জায়গা। অথচ চারপাশে অপরিষ্কার করে রেখেছে। এ সময় পাশে থাকা কবরস্থানের এক কর্মচারীকে বিষয়টি তারা জানান। কবরটি সংস্কার করে দেয়ার জন্য ওই কর্মচারীকে বলা হলে তিনি জানান, আগে টাকা দিতে হবে। আপাত ১৫০০ টাকা দিলে সংস্কার করবে। আর দেখভালের জন্য এবং মাঝে মধ্যে পরিষ্কার করার জন্য মাসে ৫০০ করে টাকা দিতে হবে। রাজধানীর ধোলাইপাড়ের অধিবাসী ওই পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করে বলেন, আমার মায়ের কবরটি সামান্য ভেঙে গেছে। এতোদিন টাকা দেয়নি তার জন্য এমন অপরিষ্কার করে রেখেছে। এখন আমরা চাচ্ছি মায়ের কবরটি সংস্কার করে রাখতে। কিন্তু অল্প কিছু মাটি দিয়ে এইটুকুন কাজ করতেই তারা ১৫০০ টাকা চাচ্ছে। আর ছোট একটা টিনের তৈরি সাইনবোর্ড দেবে তার দাম চাইছে ৫০০ টাকা। অথচ এটা আমরা বাইরে থেকে আনলে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা লাগতো। ওই পরিবারের বড় মেয়ে জানান, আমরা চাইলেই তো বাহির থেকে মাটি এনে কবরটা সংস্কার করতে পারি। আমরা গরিব মানুষ এতো টাকা দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু আমরা যদি বাহির থেকে সাইনবোর্ড আর মাটি এনে কাজ করি তাহলে তারা সাইনবোর্ড তুলে ফেলবে। ইচ্ছা করে অল্পদিনের মধ্যেই আরেকজনকে দাফন করবে। তারা এটা নিয়ে সিন্ডিকেট করে, ব্যবসা করে। তিনি বলেন, যারা টাকা দেয় শুধু তাদের কবরটাই পরিষ্কার করে রাখে। বাকিগুলো অবহেলিত। তারা আরও জানান, তাদের কাছ থেকে দাফনের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা নেয়া হয়েছে। শুধু রেজিস্ট্রেশনের জন্য ৩ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে। এছাড়া কবর খনন আর বখশিশের জন্য আরও দেড় হাজার টাকা দিতে হয়েছে।
জুরাইন এলাকার একজন বাসিন্দা জানান, কবরস্থান দেখলে মনে হয় না যে এটা পবিত্র কোনো জায়গা। পার্ক আর খেলাধুলার মাঠ বানিয়ে ফেলেছে কবরস্থানকে। দেয়াল ভেঙে ফেলেছে কিছু লোকজন। এছাড়া রাতের বেলায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা নেই। লাইটগুলো প্রায়ই নষ্ট থাকে। সেজন্য রাত নেই দিন নেই যেকোনো সময় দেয়াল টপকে নেশাগ্রস্তরা এখানে আড্ডা দেয়। এ ছাড়া কবরস্থানের পাশের ড্রেনগুলোর অবস্থাও খুবই শোচনীয়। নোংরা দুর্গন্ধ। তিনি অভিযোগ করেন, সিটি করপোরেশন দাফনের বিনিময়ে লাখ লাখ টাকা এখান থেকে আয় করছে। অথচ কবরস্থানের পরিবেশের দিকে তাদের কোনো নজর নেই।
এ বিষয়ে জুরাইন কবরস্থানের মোহরার মো. হাসান বলেন, অতিরিক্ত টাকা নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যদি কেউ অনিয়ম করে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কবরস্থানের বর্তমান ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক ফায়সাল চৌধুরী বলেন, সরকার যেটা নির্ধারণ করে দিয়েছে সেটাই নেয়া হয়। রিসিট দিয়ে টাকা নেয়া হয় সুতরাং অতিরিক্ত টাকা নেয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, কবরস্থানে সিটি করপোরেশনের লোক কম। তাই দাফন-কাফন থেকে শুরু করে সব কাজই আমার প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা করে থাকে। আমার দায়িত্ব শুধু দাফন-কাফন পর্যন্ত। এরপর তার রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা দেখাশোনার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। কিন্তু সিটি করপোরেশনের লোক না থাকায় আমার কর্মচারীরাই মৃতের স্বজনদের কাছ থেকে টাকার মাধ্যমে কবরগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন।
ডিএসসিসি’র সহকারী সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা মো. সামছুল আলম বলেন, কবরস্থানে পাহারাদার বা নিরাপত্তাকর্মীর সংকট আছে। ১৭ একরের এতো বড় একটা কবরস্থানের জন্য সিটি করপোরেশনের আরও লোকবল দরকার। কবরস্থান রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও সিটি করপোরেশনের স্থায়ী লোকবল নেই। ফলে ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা মৃতের স্বজনদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কবর দেখাশোনা কিংবা ভেঙে গেলে ঠিক করে দেয়া; এগুলো করে থাকে। দেয়াল টপকে ভবঘুরে কিংবা এলাকার লোকজন ভেতরে প্রবেশ করে। খেলাধুলা করে। এগুলো সম্পন্ন নিষেধ। তিনি বলেন, কবরস্থান একটি পবিত্র জায়গা। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে পবিত্র মনে হয় না। তাই আমি স্যারদের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলেছি। ইতিমধ্যেই সিটি করপোরেশন উদ্যোগ নিয়েছে। কবরস্থানের চারপাশে নেট দিয়ে ঘিরে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অচিরেই কাজ শুরু হবে বলে জানান তিনি।