একের পর এক মৃত্যু, দিনভর বিক্ষোভ : শেষ কোথায়?
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:৩৬ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এখন ৯ দফায় গিয়ে ঠেকেছে। যদিও ২০১৮ সালেই বৃহৎ আন্দোলনে এই ৯ দফা পেশ করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তিন বছর পর একই দাবি আবার সামনে এসেছে। অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে চলা আন্দোলনের মধ্যেই ঢাকা দক্ষিণ সিটির ময়লাবাহী গাড়ি চাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যু হয়। পরের দিন আন্দোলনে যুক্ত হয় এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি। এই দিন আন্দোলন চলার মধ্যেই চাঁদপুরে মারা যান তিন কলেজ শিক্ষার্থী। নয় দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার আগের দিন রাতে রামপুরায় বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যান এসএসসি ফল প্রত্যাশী মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়। তার মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা গতকাল দিনভর বিক্ষোভ করেছেন। এ দিন সকালে ঢাকায় অর্ধেক ভাড়া কার্যকরের ঘোষণা দেয়া হলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কোনো ছেদ পড়েনি। ওই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে শিক্ষার্থীরা ৯ দফার পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবি করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, একের পর এক মৃত্যু হচ্ছে। প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে প্রাণ। এভাবে আর কতো প্রাণ ঝরবে? সড়কের নৈরাজ্য থামাতে শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
সোমবার রাতে অনাবিল পরিবহনের ধাক্কায় প্রাণ হারায় এসএসসি ফল প্রত্যাশী দুর্জয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী সড়কে নেমে অন্তত ১০টি বাসে অগ্নিসংযোগ করেন। ভাঙচুর চালানো হয় আরও কয়েকটি বাসে। দুর্জয়ের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই আবার সড়কে সরব হন।
বেলা ১১টা থেকে রামপুরা এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন। দাবি আদায়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন তারা। সড়কের বিশৃঙ্খলা রুখতে পরীক্ষা করেন ড্রাইভিং লাইসেন্স ও প্রয়োজনীয় সব কাগজ।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে স্লোগান দেন। প্ল্যাকার্ডে লিখা ছিল- ‘উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছে দেশ, বাসের নিচে ছাত্র মরে সোনার বাংলাদেশ’, ‘একটা লাশ=একটা ব্রিজ’, ‘আস্তে মামা, আম্মু আমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে’, ‘মা বোনের কান্না আর না, আর না’, ‘ড্রাইভার মামা গাড়ি আস্তে চালাও, আমি মরলে আম্মু কাঁদবে’, ‘হাঁটেন, হাঁটতে থাকেন, রাস্তা বন্ধ, রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে’, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় পরিবহন সন্ত্রাসের ঠাঁই নাই’, ‘রাতের আঁধারে শিক্ষার্থী মরে, প্রশাসন ঘুম পাড়ে’, ‘দেশ কেন ডুবে বিষে, দেশের মেধা এই দেশ রাস্তায় পিষে’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘মা তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’ ইত্যাদি।
শিক্ষার্থীরা স্লোগানে স্লোগানে মুখর করে রাখে রাজপথ। এ সময় মূলত ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান দেয়। এ ছাড়াও ‘আমার ভাই মরলো কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘আমার ভাই কবরে প্রশাসন কি করে?’, ‘মা তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’, ‘এতো লোকের লাইসেন্স নাই, পুলিশের কাজটা জানতে চাই’ ইত্যাদি।
সড়কে অবস্থান চলাকালে শিক্ষার্থীরা বাস ছাড়া অন্যান্য যানবাহন ছেড়ে দেন। যেসব যানবাহনে বৈধ কাগজপত্র ছিল তাদের পরিবহনে ‘ওকে’ লিখে দেন শিক্ষার্থীরা। আর যেসব গাড়িতে বৈধ কাগজ কিংবা লাইসেন্সের মেয়াদ ছিল না তাদের পুলিশের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। জরিমানার আবেদন করা হয়। আর শিক্ষার্থীরা শিক্ষার্থী, এম্বুলেন্স কিংবা জরুরি পরিবহনের জন্য ইমাজেন্সি লেন প্রস্তুত রাখে।
লাইসেন্সের মেয়াদ ছিল না জামাল উদ্দিন নামে এক চালকের। তিনি জানতেন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা করছেন। অবস্থা বেগতিক দেখে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। এরপর রীতিমতো দৌড়ে তার গাড়ি আটক করেন শিক্ষার্থীরা। জরিমানাও করা হয় গাড়িটিকে। সামনে বড় করে লিখে দেয়া হয় ‘লাইসেন্স নাই’।
আবার স্থানীয় এক ছাত্রলীগ নেতার মোটরসাইকেলের কাগজপত্র ঠিক ছিল কিন্তু ছিল না হেলমেট। প্রথমে এক শিক্ষার্থী আটকান তাকে। তাকে কাগজ দেখাতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। বেশ ক’জন শিক্ষার্থী জড়ো হলে কাগজ দেখালেও হেলমেট না থাকায় আটকিয়ে দেয়া হয়। চলে বাকবিতণ্ডা। এ সময় প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরান সেই নেতা। কিন্তু এতে আরও ক্ষিপ্ত হন শিক্ষার্থীরা। সিগারেট ফেলতে বাধ্য হন। এরপর তার এক সহযোগী হেলমেট নিয়ে আসেন আরেক মোটরবাইকে। তারপর ছাড়া পান তিনি।
লাইসেন্স চেকের এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের এক মোটরসাইকেল চালকের কাছে ‘সরি’ বলতেও দেখা যায়। হাসান নামে এক মোটরসাইকেল চালক শিক্ষার্থীদের শাসন করেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি প্রয়োজনে একশ’ বার লাইসেন্স দেখাব। আমার নতুন মোটরসাইকেলে কেন ওকে লিখলো। এটা লেখার আগে পারমিশন নিয়েছে তারা? আমার মোটরসাইকেল কেনার এখনো এক সপ্তাহ হয়নি। প্লাস্টিক খোলা হয়নি। এরপর শিক্ষার্থীরা একাধিকবার সরি বলবার পর চলে যান তিনি।
লাইসেন্স চেকের কবলে পড়ে বাস ছেড়ে পালান বিআরটিসি বাসের চালক ও সহযোগী। জানা যায়, লাইসেন্স চাইলে বাসে থাকা চালক ও সহকারী পালিয়ে যান। এরপর যাত্রীরা নেমে যান। সকাল থেকেই সড়কের মাঝেই পড়ে ছিল বাসটি।
আন্দোলনের মুখে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে সাধারণ যাত্রীদের। তবে এতে নৈতিক সমর্থনের কথা জানান সৈয়দা শারমিন। তিনি বলেন, আমার ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছি। আমি বাসে যাতায়াত করি। আজ হেঁটে যেতে হচ্ছে। কষ্ট হলেও আফসোস নেই আমার। তাও আমার সন্তানসহ সব সন্তান সড়কে নিরাপদে চলাচল করুক।
সহপাঠীর মৃত্যুর বিচার দাবিতে সড়কে আন্দোলন করেন বিএএফ শাহীন কলেজ, ইম্পেরিয়াল কলেজ, খিলগাঁও মডেল কলেজ, একরামুন্নেছা স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তারা সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সড়কে অবস্থান নেন। আন্দোলন শেষ করে আজ বুধবারও সড়কে থাকার ঘোষণা দেন। খিলগাঁও মডেল কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া বলেন, মঙ্গলবার আমরা আমাদের আন্দোলন স্থগিত করছি। তবে বুধবার আমরা আবারো সড়কে নামবো। আমরা আমাদের বন্ধুকে হারিয়েছি, ভাইকে হারিয়েছি। আজ আমরা যদি থেমে যাই আবার নতুন কোনো দুর্জয়ের জন্য সড়ক অবরোধ করতে হবে। আমরা চাই না বারবার মায়ের কোল খালি হোক। তাই আমরা আমাদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলন চালিয়ে যাবো। একটা পরিবর্তনের জন্য লড়াই করবো। এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, বুধবার আমরা নির্দিষ্ট দাবি উত্থাপন করবো। আরও অধিক সংখ্যায় আন্দোলনে আসবো। এ সময় তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানের পোশাক ও পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেন।
ঘোষণা অনুযায়ী ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর অবরোধ করে মঙ্গলবার আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় বলেন, তাদের ঘোষিত ৯ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সড়কে থাকবেন তারা। রাপা প্লাজার সামনে প্রায় প্রতিদিনই অবরোধ করছেন শিক্ষার্থীরা। যাতে এই এলাকার আশেপাশের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে নানা স্লোগান দেন ও প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। সেইসঙ্গে প্রতিদিনের মতো লাইসেন্স পরীক্ষা করেন।