সিলেটে সাত মৌজার ‘অঘোষিত’ শাসন : মাস্টার নজির আহমদের কান্না
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:১১:০৬,অপরাহ্ন ২৩ আগস্ট ২০২১
ওয়েছ খছরু:
সাত মৌজার ‘অঘোষিত’ শাসন চলছে সিলেটের গোয়াইনঘাটের পাচ সেঁউতী বাজারে। মৌজার ডাকে সাড়া না দিলে পড়তে হচ্ছে কঠোর শাস্তির মুখে। গ্রাম থেকে রাখা হচ্ছে বিচ্ছিন্নও। এমন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন ওই
এলাকার অবসরপ্রাপ্ত এক মাদ্রাসা শিক্ষক মাস্টার নজির আহমদ। জমির মালিকানা চাইতে গিয়ে তিনি এখন মৌজার নিয়ন্ত্রকদের শাস্তির মুখে পড়তে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে মৌজার শাসকরা ঘন ঘন বৈঠক করছেন। দিচ্ছেন চোখ রাঙানিও। এতে পুলিশ হস্তক্ষেপ করায় আপাতত স্বস্তি মিলেছে।
কিন্তু বিরোধে জড়িয়ে পড়ায় এখন তিনি ও তার স্বজনদের বাজারে যাওয়া-আসাই বন্ধ হয়ে গেছে। গোয়াইনঘাটের বারহাল আলিম মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষক মাস্টার নজির আহমদ। স্থানীয় পাচ সেঁউতী বাজারে তিনি ও তার আত্মীয়স্বজনের প্রায় ৫৭ শতক জমি রয়েছে। এসব জমি এতদিন বাজারে অব্যবহৃত অবস্থায় ছিল। গত মাঠ জরিপেও বাজারের ওই ভূমি প্রকৃত মালিকদের নামে সরকারের খাতায় তালিকাভুক্ত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাজার ও সাত মৌজার নিয়ন্ত্রকরা ওই জমি বাজারের দাবি করে রেকর্ড ভাঙতে আদালতে মামলা করেন। মাস্টার নজির আহমদ ও তার আত্মীয়স্বজন ওই আদালতে মালিকানা নিয়ে লড়াই করছেন। গত ১৩ই জুলাই বাজারের ওই ভূমিতে জোরপূর্বক দোকানকোঠা নির্মাণের চেষ্টা চালান বিলাল উদ্দিন, হাসন আলী, হারিছ উদ্দিন সহ কয়েকজন। এতে বাধা দেন মাস্টার নজির আহমদ, তার চাচাতো ভাই আব্দুন নুর সহ কয়েকজন। এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিলে গোয়াইনঘাট থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই ভূমিতে মৌখিক স্থিতাবস্থা দেয়। এবং জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত একই অবস্থায় থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। এ ঘটনার পর মাস্টার নজির আহমদ স্থিতিবস্থা জারি চেয়ে গত ১২ই আগস্ট সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আবেদন করেন। তার আবেদন মতো আদালতও একই জমির উপর স্থিতাবস্থা দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশ পেয়ে গোয়াইনঘাট থানার এএসআই মোস্তাক আহমদ প্রথম পক্ষ মাস্টার নজির আহমদ, দ্বিতীয় পক্ষ বিলাল উদ্দিন, হাসন আলী, হারিছ উদ্দিন, নুরুল হক, শওকত আলী ও আব্দুর রবের নাম উল্লেখ করে জমির উপর ১৪৪ ধারা জারি করে আসেন। এখনো জমিটি ওই অবস্থায় রয়েছে। আইনি লড়াই চলমান থাকার পর পাচ সেঁউতীর সাত মৌজার ব্যানার নিয়ে অভিযুক্ত বিলাল, হাসন, হারিস সহ কয়েকজন সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।
মাস্টার নজির আহমদ গতকাল জানিয়েছেন- ঘটনার প্রেক্ষিতে পুলিশ এসে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলো সেটি সাত মৌজার নিয়ন্ত্রণে ওই দুষ্কৃতকারী মানেনি। বরং তারা সাত মৌজাকে পুঁজি করে তাদেরকে পাচ’র বাদ করার প্রক্রিয়া চালায়। মৌজার পক্ষ থেকে তিনি ও তার চাচাতো ভাই আব্দুন নুর সাড়ে ৭ লাখ টাকা নিয়ে মৌজার বিচারে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে সহযোগিতা করায় এলাকার সচেতন যুবক সালেহ রেজাকেও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। বিষয়টি তারা পুলিশকে অবগত করেছেন। গোয়াইনঘাট থানা পুলিশ এসে মৌজার নিয়ন্ত্রকদের শাসিয়ে গেলে তারা আরও ক্ষেপে উঠে। তিনি জানান, গত শনিবারও মৌজার পক্ষ থেকে বৈঠক করা হয়েছে। ওই বৈঠকে শাস্তি ঘোষণা না হলেও আমাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি জানানো হয়েছে। বৈঠকে সাবেক মেম্বার হাসন ও তার সহযোগীরা মূল ভূমিকা পালন করছে বলে দাবি করেন তিনি। মাস্টার নজির আহমদের চাচাতো ভাই জানিয়েছেন, বাজারে থাকা তাদের জমি দখলে নিতে এর আগে তাদের স্বজন কাজিম আলীর ছেলে ফয়সল আহমদের সঙ্গেও একই আচরণ করা হয়েছিলো। পরে বিষয়টি স্থানীয় পূর্ব আলীর গাঁও ইউনিয়নের বর্তমান প্রশাসক শফিক আহমদ সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি জানান, চলমান আইন যেখানে বিদ্যমান সেখানে সাত মৌজার নামে ভূমিখেকোরা নানাভাবে জমি দখলের চেষ্টা চালিয়েছে। আর জমি দখলে নিতে তারা আইনের তোয়াক্কা না করে সাত মৌজার সিদ্ধান্তকে আইন বলে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। যারাই ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিরোধিতা করে তাদের বিরুদ্ধে মৌজার নামে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। এতে করে এলাকার মানুষ কয়েকজন মানুষের কাছে জিম্মি হয়ে গেছেন। স্থানীয় পূর্ব আলীর গাঁও ইউনিয়নের প্রশাসক শফিক আহমদ জানিয়েছেন, বাজারের ভূমি নিয়ে বিরোধের মীমাংসা তিনি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার ডাকে সাত মৌজা কিংবা বাজারের লোকজন আসেননি। তার সালিশের বিচারকে তারা নানাভাবে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেন। ডাকে সাড়া না দিলেও পরবর্তীতে একটি ভুয়া উত্তরাধিকার সার্টিফিকেট নেয়ার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু ইউনিয়নের তরফ থেকে সেটি দেয়া হয়নি।
সাত মৌজার বাজার সেঁউতীর পর পর নির্বাচিত সভাপতি ও মৌজার মুরব্বি আব্দুশ শুকুর জানিয়েছেন, পাচ সেঁউতীর বাজার সাত মৌজার মানুষরাই পরিচালনা করেন। বাজারের ভূমি নিয়ে বিরোধ চলছে। সেটি আইন দেখছে। তবে- ভূমি বিরোধ নিয়ে সাত মৌজার বৈঠকে তিনি যাননি। তার ব্যক্তিগত ব্যস্ততার জন্য তিনি দূরে রয়েছেন। তিনি জানান, বিষয়টি যেহেতু আইনে গেছে এখন আইনই ফয়সালা দেবে। এ কারণে এখন সবাইকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
গোয়াইনঘাট থানার সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর মো. মোস্তাক আহমদ জানিয়েছেন, ভূমির মালিকরা যে সহযোগিতা চাইছেন তা দেয়া হচ্ছে। সাত মৌজার নামে কোনো অগ্রহণযোগ্য কাজ হলে সেটিও আইনমত দেখা হবে। এসব কথা তিনি স্থানীয় এলাকায় গিয়ে সবাইকে বলে এসেছেন। তিনি জানান, আদালতের নির্দেশের প্রেক্ষিতে ওই জমিতে ১৪৪ ধারা জারি আছে। এখানে অন্য কারও হুকুম চলবে না। যারাই আইনের ব্যত্যয় ঘটাবে পুলিশ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সাত মৌজাবাসীর একাধিক বৈঠকে মাস্টার নজির, চাচাতো ভাই আব্দুন নূরকে ডেকে পাঠানোর কথা গতকাল স্বীকার করেছেন মৌজার নিয়ন্ত্রক হাসন আলীও। তিনি জানিয়েছেন, সাত মৌজার কাছ থেকে মাস্টার নজির ও স্বজন আব্দুন নূর ৫০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। ওই টাকা ফেরত দিতে তাদের মৌজাবাসীর পক্ষ থেকে ডাকা হলেও তারা উপস্থিত হননি। এ কারণে শনিবারের রাতের সাত মৌজার বৈঠক কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে।
এদিকে- বাজারে ভূমি দখলে মাস্টার নজির আহমদ ও আব্দুন নূরের পক্ষ নিয়েছিলেন স্থানীয় বারহাল বাজারের ব্যবসায়ী ও এলাকার যুবক সালেহ রেজা। মৌজার বিপক্ষে গিয়ে অপরপক্ষের পক্ষ নেয়ায় তাকেও ৫০ হাজার টাকার দণ্ড দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি। তবে তিনি মৌজার ডাকে সাড়া দেননি। জানান, গত বৃহস্পতিবার বিকালে তিনি স্থানীয় পাচ সেঁউতী বাজারে গেলে হাসন আলী তাকে গালিগালাজ ও প্রাণে হত্যার হুমকি দেয়। এ ঘটনায় তিনি শনিবার গোয়াইনঘাট থানায় অভিযোগ দিয়েছেন।
গোয়াইনঘাট থানা পুলিশ জানিয়েছে, সালেহ রেজাকে গালিগালাজের প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। দুষ্কৃতকারীরা আইন না মানলেও নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।