মামুনুলের সমালোচনাই কি কাল হলো শাল্লা যুবলীগ নেতা অপুর?
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুলাই ২০২১, ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় পুলিশের এক উপপরিদর্শকের ওপর হামলার অভিযোগে ১২ জুলাই রাতে গ্রেপ্তার করা হয় উপজেলা যুবলীগ নেতা অরিন্দম চৌধুরী অপুকে। তিনি উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়কও।
এ মামলায় অপু ছাড়া আরও দুজনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন বিশ্বজিৎ রায় ও রতন রায়। এর মধ্যে গ্রেপ্তার আছেন রতন রায়।
অপুর বিরুদ্ধে মাদক আইনেও একটি মামলা করা হয়েছে।
অপুর পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ কর্মকর্তার ওপর হামলার ঘটনাটি সাজানো। হেফাজত নেতা মামুনুল হককে নিয়ে প্রচারিত একটি সংবাদের লিংক ফেসবুকে শেয়ার করার জেরে তাকে ফাঁসানো হয়। তাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে নির্যাতনও করা হয়।
অপুর বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ করেছেন যিনি, শাল্লা থানার সেই উপপরিদর্শক (এসআই) শাহ আলী আহত অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি ছিলেন। গত শুক্রবার ছাড়া পেয়েছেন।
জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান শনিবার বলেন, পরিবারের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে তদন্ত করে দেখা হয়েছে। অপুকে হেফাজতে নির্যাতনের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
এসআইয়ের ওপর হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষে এ ব্যাপারে বলা যাবে। এখন আমার এসআই আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। তার চোখের নিচে, পা ও শরীরে আঘাতের চিহ্ন আছে। হামলা না হলে এই আঘাতের চিহ্ন কোথা থেকে আসলো। কেউ আক্রান্ত হলে তো আইনের আশ্রয় নিতেই পারে। তবে তদন্ত শেষ হলে সব বলা যাবে।’
তবে অরিন্দম চৌধুরী অপুর ভাই আইনজীবী অমিতাভ চৌধুরী রাহুলের দাবি, হামলার অভিযোগ আনা এসআই শাহ আলী সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা থেকে তার ভাইকে ফাঁসিয়েছেন।
অমিতাভ বলেন, গত ৩ এপ্রিল হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের তৎকালীন নেতা মামুনুল হক নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে বেড়াতে গিয়ে জনরোষে পড়ার পরদিন তার স্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথনের একটি অডিও ফাঁস হয়। যা প্রচার করে একাত্তর টিভি। ওই সংবাদের লিংক ফেসবুকে শেয়ার করেন অপু। এরপর স্থানীয় কয়েকজন তাকে হুমকি দেয়।
এর আগে ১৭ মার্চ একই উপজেলার নোয়াগাঁওয়ে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। এ কারণে ফেসবুকের হুমকির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে ১০ এপ্রিল শাল্লা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন অমিতাভ।
অমিতাভ বলেন, ‘সাধারণ ডায়েরি করার পরও থানা থেকে হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে আমার ভাইয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। তখন এসআই শাহ আলী আমার ভাইকে তার ফেসবুকে দেয়া লিংক মুছে ফেলার কথা বলেন এবং সাধারণ ডায়রি থেকে হেফাজত ইসলামের প্রসঙ্গটি বাদ দিতে চাপ দেন।
‘এসআই শাহ আলীর চাপ প্রয়োগের বিষয়টি গত ১৪ এপ্রিল আমরা পুলিশ সুপারকে লিখিতভাবে জানাই। পরে সার্কেল এএসপি বিষয়টি অনুসন্ধান করেন এবং এসআই শাহ আলীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয় বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
এসপির কাছে অভিযোগ দেয়ায় শাহ আলী ক্ষুব্ধ হন অপুর ওপর, এমন অভিযোগ অমিতাভের।
তিনি বলেন, ‘এই ঘটনার জেরেই এখন আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে হামলার মিথ্যে অভিযোগ তোলা হয়েছে। অথচ ঘটনার রাতে তিনি বাসায় ছিলেন। বাসা থেকে তাকে থানায় একটি জরুরি কাজের কথা বলে ডেকে নেয়া হয়। এরপর সেখানে তাকে রাতভর মারধর করা হয়। ভোররাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে একজন ফোন দিয়ে আমাদের এ তথ্য জানায়। এরপর আমরা হামলা ও গ্রেপ্তারের বিষয়টি জানতে পারি।’
অপুর বিরুদ্ধে মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, সোমবার মধ্যরাতে ডিউটি শেষ করে থানা থেকে বের হয়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন তিনি। পথে অপুর নেতৃত্বে কয়েকজন যুবক এসআই শাহ আলীর উপর হামলা করেন। এতে গুরুতর আহত হন শাহ আলী।
এ ব্যাপারে শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর আলম শনিবার বলেন, ‘পুলিশের ওপর হামলা মামলাায় দুজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়টি এখন তদন্তাধীন। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আমি কোনো মন্তব্য করবো না।’
ওসির দাবি, ওই রাতে অপুকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি।
এসব বিষয়ে এসপি মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে শনিবার তিনি বলেন, ‘জিডি করার পর চাপ প্রয়োগের যে অভিযোগ করা হয়েছে তা ওই সময়ই শেষ হয়ে গেছে। যে এসআইকে তারা অভিযুক্ত করেছিলেন তাকেই বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেই। তিনি প্রতিবেদন জমাও দেন। ফলে এই ঘটনার জেরে এখন গ্রেপ্তার করা হয়েছে এমন অভিযোগ সঠিক নয়।’
এসপি বলেন, ‘থানা হেফাজতে অপুকে নির্যাতনের কোনো প্রমাণ পাইনি। গ্রেপ্তারের দিন তিনি মাদক নিয়েছিলেন। মাদক পরীক্ষার জন্যই তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। অসুস্থ হওয়ার কারণে নয়। তারপরও অপুর পরিবার যদি মনে করেন তাকে নির্যাতন করা হয়েছে, তবে তারা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।’
তিনি জানান, অপুর বিরুদ্ধে এর আগেও একাধিক মামলা রয়েছে থানায়। এর মধ্যে একটি পুলিশ এসল্ট মামলা। ফলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন কিছু নয়।
গ্রেপ্তারের পর থানা থেকে রাতে অপুকে হাসপাতালে নেয়ার কারণ জানতে চাইলে শাল্লা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সুমন ভুইয়া বলেন, ‘তখন আমি হাসপাতালে ছিলাম না। ফলে কেন আনা হয়েছিল বলতে পারব না। এছাড়া এটি কয়েকদিন আগের ঘটনা। প্রতিদিন হাসপাতালে অনেক রোগী আসেন। কে কী সমস্যা এসেছিলেন তা মনে রাখা সম্ভব নয়।’
আহত অবস্থায় এসআই শাহ আলীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাকে শুক্রবার ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সিলেটে গিয়ে পরবর্তী চিকিৎসা নিতে বলা হয়েছে।
অরিন্দম চৌধুরী অপুকে গ্রেপ্তারের খবরে ফেসবুকে দেয়া এক স্ট্যাটাসে লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হাসান মোরশেদ লেখেন, ‘অপু ৭১ টিভির রিপোর্ট শেয়ার করার পর শুরু হয় তাকে মেরে ফেলার হুমকি-ধামকি। এমনকি তার স্ত্রীর ছবি বিকৃত করে নোংরামী করা হয়। অপু তখন আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়। ঐ অবস্থায় থানায় জিডি করেন তার ভাই। কিন্তু থানার একজন এসআই উল্টো টালবাহানা করে জিডি না নিয়ে বরং তাকে চাপ দেন হেফাজতের নাম উল্লেখ না করতে। অপু এই এসআই এর বিরুদ্ধে সুনামগঞ্জ জেলা এসপির কাছে অভিযোগ করলে ওই এসআইকেই নির্দেশ দেয়া হয় জিডি গ্রহণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে।
‘সুনামগঞ্জের এসপি সাহেবের আলাপ থেকে স্পষ্ট, উক্ত এসআই সে সময় অপুর সাধারণ ডায়েরি নিতে চায়নি। পরে এসপি সাহেবের নির্দেশে সে সাধারন ডায়েরি নিতে বাধ্য হয়। যেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মামনুল হক ও হেফাজতের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন সেখানে একজন এসআইয়ের এতো হেফাজত প্রেম কেন? তার এই ভূমিকার জন্য পুলিশের কোনো বিভাগীয় তদন্ত হয়েছিল কিনা?’
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক খায়রুল হুদা চপল বলেন, ‘বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। আমি পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলেছি। এ ঘটনার যাতে সুষ্ঠু তদন্ত হয় এবং সে ন্যায় বিচার বঞ্চিত না হয় এ ব্যাপারে পুলিশ সুপারকে অনুরোধ করেছি।’
অপুকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় শুক্রবার বিকেলে ‘সচেতন শাল্লাবাসীর’ ব্যানারে সিলেট নগরে মানববন্ধন করা হয়। সেখানে অপুর পরিবারের পক্ষে একই অভিযোগ আনে শাল্লাবাসী।
এর আগে গত ১৭ মার্চ ফেসবুকে মামুনুল হকের সমালোচনা করে স্ট্যাটাস দিয়ে শাল্লার নোয়াগাওয়ে হিন্দু গ্রামে হামলা চালানো হয়। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় হিন্দুদের শখানেক ঘরে। এই ঘটনার প্রতিবাদেও অপু সোচ্চার ছিলেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।