সিলেটে বেপরোয়া কিশোরদের হাতে জিম্মি সাধারণ মানুষ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ জুন ২০২১, ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
সিলেটে দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর অপরাধীরা, স্কুল-কলেজ ও এলাকায় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আধিপত্য বিস্তার কিংবা দ্বন্দ্ব মেটাতে কয়েকজন কিশোর মিলে গড়ে তুলছেন গ্যাং। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন স্পটে কিশোর-তরুণরা মিলে নিয়মিত আড্ডা দিচ্ছে পাশাপাশি মেয়েদেরও উত্যাক্ত করছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা জড়াচ্ছে হামলা, অপহরণ, হত্যা ও ধর্ষণের মতো বড় অপরাধে।
প্রতিদিন কোনো না কোনো এলাকায় জুনিয়র-সিনিয়র বা নারীঘটিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিশোরদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটছে। যার শেষ পরিণতি অস্ত্রবাজি থেকে রক্তারক্তির মতো ঘটনা। আর এসব অপরাধে এখন নাজেহাল হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ফলে কিশোর গ্যাংদের হাতে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছেন পাড়া-মহল্লার মানুষ।
পুলিশ বলছে, এসব কিশোর অপরাধী ও কিশোর গ্যাংদের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার রয়েছে। কোথাও কোনো অপরাধের খবর পেলে তারা সাথে সাথে অ্যাকশনে যাচ্ছেন।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিশোর অপরাধের দায় নিতে হবে পরিবার আর রাষ্ট্রকেই। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নৈতিক চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করার পূর্বে নিজ সংশোধন হতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কিশোরের অভিভাবকদের অতীত বা বর্তমান হাল চিত্র তার সন্তানদের নিকটই বির্তকিত।
সিলেটে নগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় গড়ে ওঠেছে ছোট-বড় কিশোর গ্যাং। জেলার বিভিন্ন উপজেলায়ও রয়েছে এমন গ্যাং। কোনো কোনো এলাকায় রয়েছে এমন একাধিক গ্রুপ। আধিপত্য বিস্তার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রায়ই এসব গ্যাংয়ের কিশোররা জড়িয়ে পড়ে সংঘাতে। এক গ্রুপের সদস্যকে অন্য গ্রুপের সদস্যরা তুলে নিয়ে মারধর, পাল্টা প্রতিশোধ- এসব ঘটনা এখন সিলেটের নিত্যদিনের।
গত বুধবার নগরভবনে হামলা চালায় ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। ওই হামলায় অংশ নেয় শতাধিক কিশোর। নগরভবন লক্ষ্য করে তাদেরকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে দেখা যায়। সিটি করপোরেশনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে এ দৃশ্য ধরা পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রিকশাচালকদের পক্ষ নিয়ে হামলার জন্য একটি মহল কয়েকটি কিশোর গ্যাং ভাড়া করেছিল।
এর আগে গত সোমবার রাত সাড়ে ৯টায় দক্ষিণ সুরমার নভাগ গ্রামের হেলাল উদ্দিনের কিশোর ছেলে তৌফিকুল ইসলাম তামিমকে বাড়ি থেকে ডেকে বের করে দুই কিশোর। বাড়ির রাস্তায় বের হওয়ার পর আরও ৬ কিশোর ঘিরে ধরে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এসময় তামিমের শোরচিৎকার শুনে তার মা-বাবা ও আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে ওই ৮ কিশোরকে আটক করেন। তাদেরকে ছাড়িয়ে নিতে আরও ৮ কিশোর এগিয়ে আসলে তাদেরকেও আটক করে স্থানীয় লোকজন। খবর পেয়ে পুলিশ এসে ওই ১৬ কিশোরকে থানায় নিয়ে যায়। পরদিন সকাল সাড়ে ১১টায় স্বজনদের জিম্মায় তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়।
দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি মো. মনিরুল ইসলাম জানান, ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে তামিমকে অপহরণ করতে গিয়েছিল ওই ১৬ কিশোর। পরে সংশোধনের জন্য অভিভাবকদের জিম্মায় তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
গত ২৭ মে রাতে সিলেট নগরীর নয়াসড়ক কিশোরী মোহন স্কুলের সামনে থেকে দুই কিশোরকে অপহরণ করে কিশোর গ্যাংয়ের ১০-১২ জন সদস্য। পূর্ব জিন্দাবাজার আসার পর স্থানীয় লোকজনের প্রতিরোধের মুখে অন্যরা পালিয়ে গেলে তিনজনকে আটক করে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, কয়েক দিন আগে অপহৃত কিশোররা অন্য একটি গ্রুপের এক কিশোরের উপর হামলা চালিয়েছিল। এর জের ধরে ঐ গ্রুপের কিশোররা ওইদিন তাদেরকে পেয়ে অপহরণের চেষ্টা চালিয়েছিল।
নগরীর শাহী ঈদগাহ, কাজীটুলা, নয়াসড়ক, জেল রোড,উপশহর, শিবগঞ্জ, টিলাগড়, বালুচর, কল্যাণপুর, শাপলাবাগ, মেজরটিলা, লামাপাড়া, মাদানীবাগ, জল্লারপার, জিন্দবাজার, লামাবাজার, মির্জাজাঙ্গাল,রিকাবীবাজার, তালতলা, তেলিহাওর, শেখঘাট, মাছুদিঘিরপার, জামতলা, সুরমা মার্কেট, বন্দরবাজার, মিরবক্সটুলা, আম্বরখানা, দর্শনদেউড়ি, রাজারগলি, হাউজিং এস্টেট, ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই, মজুমদারি, বাঘবাড়ি, মদিনা মার্কেট, পীরমহল্লা, ফাজিলচিশতসহ নগরীর প্রায় সবকটি এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্যরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে।
গেল কয়েকদিন আগে নগরীর আম্বরখানা ইলেকট্রিক সাপ্লাই এলাকায় একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপর এক গ্রুপের উপর হামলা চালায়। পরদিন পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে। এসময় এক কিশোর ও তার বাবাকে বেধড়ক মারধর করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
এ প্রসঙ্গে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) বি এম আশরাফ উল্যাহ তাহের জানান, কিশোর অপরাধ রুখতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতার। বিশেষ করে অভিভাবকমহলকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিলছে- এ ব্যাপারে খোঁজ নিলে সন্তানরা অপরাধে জড়াতে পারবে না।
সিলেট জেলা পুলিশের গণমাধ্যম কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. লুৎফর রহমান জানান,শুধু আইনের প্রয়োগ করেই কিশোর গ্যাং থামানো যাবে না। এক্ষেত্রে পরিবারকে আরও সোচ্চার হতে হবে। আপনার সন্তান কী করছে? কার সঙ্গে মিশছে, তা জানা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সন্তানকে সময় দেওয়া, তার সঙ্গে গল্প করা, তার মনের অবস্থা বোঝা, তার কাছে বাবা-মায়ের অবস্থান তুলে ধরা। আরও সহজভাবে বলতে গেলে, অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানের বন্ধন খুবই জরুরি। এ বন্ধন যত হালকা হবে, সন্তান তত বাইরের দিকে ছুটবে, বাইরের কলুষিত বিষবাষ্প গ্রহণ করবে। তখন আর তাকে ফেরানোর কোনো রাস্তা থাকবে না।