অভিযোগ পায় না কুবি প্রশাসন, বিচার করে ছাত্রলীগ!
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:৫৭:৪১,অপরাহ্ন ০৫ মার্চ ২০২১
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারি কিংবা শৃঙ্খলাবিরোধী কাজের ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশ ঘটনারই প্রশাসনিকভাবে আনুষ্ঠানিক কোনো বিচার হয় না। অভিযোগ না আসার দোহাই দিয়ে গত দুই বছরে সংগঠিত হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ শৃঙ্খলাবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, সংঘর্ষ-মারামারির ঘটনায় তারা লিখিত অভিযোগ পান না। যার ফলে নিতে পারেন না প্রশাসনিক ব্যবস্থা।
কিন্তু অভিযোগ না পেলেও ঘটনাগুলোর আপস-মীমাংসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্র সংসদ না থাকলেও ‘ছাত্র প্রতিনিধি’র নাম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে এসব ঘটনার আপস-মীমাংসার ভার তুলে দেওয়া হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের হাতে। আর নেতারাও এসব বিচার করছেন নিজেদের ইচ্ছেমতো। বিচারের নামে মারধরের অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে।
গত পয়লা মার্চ রাতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনের রাস্তায় সংঘর্ষে জড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দুই পক্ষ। এতে আহত হন দুজন। বন্ধ ক্যাম্পাসে এমন সংঘর্ষে জড়ানোর ঘটনাতেও পদক্ষেপ নেয়নি কুবি প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন এ ঘটনাতেও মীমাংসার ভার ছেড়েছেন ‘ছাত্র প্রতিনিধিদের’ হাতে।
যদিও এ ঘটনার পরপরই তিনি গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যাদের সাথে ঝামেলা হয়েছে এবং ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে কাল (ঘটনার পরদিন) বসে মীমাংসার চেষ্টা করব। তবে এই ঘটনার মীমাংসা বা বিচারে ছিল না প্রক্টরিয়াল বডি। কেবল ‘ছাত্র প্রতিনিধি’র নামে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা এ ঘটনার মীমাংসা করেন। আর মীমাংসায় এ ঘটনার অভিযুক্তকে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কর্তৃক মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিচারের নামে মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন, ‘মারধর করা হয় নি। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দিক থেকে নিজেদের মাঝে কেউ বিবাদে জড়ালে আমরা বিধি-নিষেধ দেই কিংবা মুচলেকা নেই!’
এ ঘটনার সাংগঠনিকভাবে তদন্ত না করে সালিশে বসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই ঘটনায় সবকিছু স্পষ্ট, প্রমাণিত। এছাড়া, যে ভুক্তভোগী সে ক্ষমা করে দিছে এবং আমরা সাংগঠনিক দিক থেকে সতর্ক করে দিয়েছি এবং মুচলেকা নিয়েছি। আর ভুক্তভোগী ক্ষমা করে দিলে তো আর কিছু করার থাকে না।’
বিগত কয়েক বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ে শাখা ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে বেশ কিছু মারামারি ও সাধারণ শিক্ষার্থী বা ভিন্নমতের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর ক্যাম্পাসে হামলার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অধিকাংশ ঘটনারই কোনো বিচার হয়নি। বিচার হয়নি সাংবাদিককে গুলি করে হত্যার হুমকি দেওয়ার ঘটনাতেও। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের বক্তব্য ছিল, ‘আমরা কোনো অভিযোগ পাই নি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
প্রশাসনিক বিচার না হলেও ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দ ঠিকই সালিশে বসেছেন এসব ঘটনা নিয়ে। অভিযোগ আছে, কোনো ভুক্তভোগী হামলার শিকার হলে ছাত্রসংগঠনের ভয়েই তারা প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ দেন না। তাদের চাপেই তারা মীমাংসার পথ বেছে নেন।
তবে এভাবে ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে বিবাদ কিংবা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী কর্তৃক সাধারণ শিক্ষার্থীর ওপর হামলার সালিশ-মীমাংসার ভার ছাত্রলীগ নিতে পারে কিনা জানতে চাইলে শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, ‘নিজেদের কর্মীদের ভেতর ভুল-বোঝাবুঝি হলে তা নিয়ে আমরা বসতেই পারি। আর যে ভুক্তভোগী সে তো প্রশাসনের কাছে যায়নি। আমাদের কাছে যদি কেউ আসে তাহলে আমরা তো ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে দায় এড়াতে পারি না। চেষ্টা করি সমাধানের।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলাবিরোধী বিভিন্ন কাজে প্রশাসনিক ব্যবস্থা কেন নেওয়া হয় না এ প্রসঙ্গে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব? যে মারধরের শিকার হল, সে যদি এসে বলে আমি তো অভিযোগ দেই নি। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে হয়েছে, তখন আমার উত্তর কি হবে?’
‘ছাত্র প্রতিনিধি’র হাতে মীমাংসার ভার ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের মধ্যে তৈরি সমস্যার সমাধান যদি ছাত্ররা করে, তাহলে আমাদের সেখানে ইন্টারফেয়ার করা কি উচিত? কার হাতে ছেড়ে দিচ্ছি সেটা বিষয় না, বিচার পেল কিনা সেটাই বিষয়।’
এই ছাত্র প্রতিনিধি কারা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে যারা সমন্বয় করে তারা ছাত্র প্রতিনিধি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগের অভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. এমরান কবীর চৌধুরী বলেন, ‘প্রশাসন কিছু করতে চাইলে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ আসতে হবে তো। প্রত্যেকটা সরকারি জিনিস একটা নিয়মশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে হয়। অভিযোগ আসলে তার ভিত্তিতে ঠিক করা হবে কোন পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হবে, কোন ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে। সাক্ষী-প্রমাণ দিয়ে বিচার করতে হয়। নয়তো কোর্টে গিয়ে উল্টো হয়ে যায়। আমাদের এমন কিছু খারাপ অভিজ্ঞতা আছে। তাই আমাদের কোনো কিছু করতে হলে আমাদের কাছে অভিযোগ আসতে হবে।’