আজ স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস : ষড়যন্ত্রের রোষানলে হারিয়ে যাওয়া সুনালী অতীত
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:৪৫ অপরাহ্ণ
রুহুল আলম চৌধুরী উজ্জ্বল:
সময় ও স্বার্থের প্রয়োজনে ঐতিহাসিক সত্যকে সাময়িক আড়াল করা যায়, কিন্তু সত্যের সূর্য উদয় ঠেকানোর সাধ্য কারো নেই। আজকের প্রজন্মের জানা উচিত ধার করা ভালোবাসার দিনটির চেয়েও মহিমান্বিত আরেকটি ঐতিহাসিক দিন আছে এ জাতির গৌরব গাথার। গনতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে ও এদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ বলে একটি ক্ষন রয়েছে। যে কেউ ভাবতে পারেন , আন্তর্জাতিক ভালোবাসা দিবসের ডামাডোলে আজকের এই দিনটিকে মুছে দেয়া হয়েছে।এ প্রজন্মের জানা উচিৎ বাংলাদেশের সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাজনৈতিক ইতিহাসের এক রহস্যময়চরিত্র। ইতিহাসের কোনো স্বৈরশাসকই তাদের স্বাধীনতা, দেশপ্রেম ও গনতন্ত্র বিরোধী অপকর্মের দায় এড়িয়ে যেতে পারেন নি, একমাত্র এরশাদ ছাড়া। যার শাসনকালে গনতন্ত্রকামী ছাত্রজনতার রক্তক্ষরণ হয়নি এমন দিন হাতে গোনা। ১৯৮২ সালে তাঁর শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান বিতর্কিত শিক্ষানীতি ঘোষণা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও রেজাল্ট খারাপ হলেও যারা ৫০% শিক্ষার ব্যয়ভার দিতে সক্ষম, তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয় এই ভ্রান্ত নীতিতে। এই নীতিতে দরিদ্ররা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে পারে বলে ছাত্ররা এর প্রবল বিরোধিতা করে। মুলত এর বিরদ্ধে শিক্ষার্থীরাই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের ডাক দেয়। ছাত্ররাই ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিষয়ে একমত প্রকাশ করে। এর ধারাবাহিকতায় পরের বছর ’৮৩-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি ওই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সচিবালয়ে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করে শিক্ষার্থীরা। এ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মজিদ খানের ওই কুখ্যাত শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, বন্দি মুক্তি, গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া এবং গণমুখী, অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির দাবিতে ছাত্র জমায়েত ডাক দেয়। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ডাকা ওই সমাবেশে পুলিশ গুলি করলে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। শহীদ হন জাফর, জয়নাল, দীপালি সাহাসহ অনেকেই। পরে সারা দেশেই এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম, সহ দেশের অন্যান্য স্থানেও হতাহতের ঘটনা ঘটায় এরশাদের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ। সেদিন থেকেই ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে বলা হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ সারা দেশেই ঘটেছে একের পর এক হত্যাকান্ড ও গুমের ঘটনা। প্রতিবাদী ছাত্র-শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী এমনকি সাধারণ মানুষকেও জেলে পুরে নির্যাতন করতে থাকে এরশাদ সরকার। এমন আন্দোলন-সংগ্রামের পথ বেয়ে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেনকে হত্যা করে এরশাদের পুলিশ বাহিনী। এবং ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর এরশাদের সন্ত্রাসী বাহিনী গুলি করে হত্যা করে ডা. মিলনকে। এতেও শেষ রক্ষা হয় না এরশাদের। অবশেষে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন হয় দখলবাজ স্বৈরাচার এরশাদের। কিন্তু সেই সেনাশাসক দেশের রাজনীতিবিদ ও কতিপয় হলুদ গণমাধ্যমের আপসকামিতার সুযোগে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বিদায় নিয়েছেন ধরনী থেকে।’ এই ঐতিহাসিক দিবস হিসেবে জানতে চাইলে তৎকালীন অন্যতম শীর্ষ ছাত্র নেতা, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, ১৯৭৫ পরবর্তী ডাকসুতে ছাত্রলীে থেকে নির্বাচিত ভিপি,ও ডাকসু ভবনে প্রতিক্রিয়াশীলদের রক্ত চক্ষু অপেক্ষা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির উত্তোলক,৭৫ রের প্রতিরোধ যুদ্ধা, জাতীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় নেতা সুলতান মুহাম্মদ মনসুর আহমদ বলেন ” ৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারির পর ’৮৩-এর ১৪ ফেব্রুয়ারির ছাত্র-শিক্ষকের তাৎপর্ময় বিশাল আন্দোলনকে বিস্মৃতির গহ্বরে নিক্ষেপ করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বিরোধী চক্রই চাপিয়ে দেওয়া অপসংস্কৃতির আড়ালে গণতন্ত্র যাত্রার সুনালী অতীত কে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চাইছে। সাবেক এ জাদরেল ছাত্রনেতা বলেন এখন আর এ নিয়ে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না! কিন্তু সত্য হলো এই জাফর , জয়নাল , মুজাম্মেল , দিপালী সাহা , সেলিম দেলওয়ার আওয়ামীলীগ নেতা ময়েজুদ্দিন , শ্রমিক নেতা তাজুল ইসলাম , ছাত্রনেতা চুনু , রায়ফুন বসুনিয়া চট্রলার বাবর মুজিব , রাজশাহীর শাহজাহান সিরাজ, নুর হোসেন মিলন সহ হাজারো নাম না জানা আত্মার ক্রন্দন কি থামানো যাবে? তাঁদের অভিশাপ থেকে আমাদের বোধ ও বিবেককে কি রক্ষা করার উপায় আছে ? তাদের স্বজনরাই বা কেমন অনুভব করেন, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।” পরিশেষে, বিবেকবানদের কাছে আমার জানতে চাওয়া অন্যের থেকে ধার করা দিবসের চেয়ে এদেশের ছাত্রজনতার বীরত্বের ইতিহাস ধারণ ও পালন কি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব নয়। বলাবাহুল্য ভালোবাসা দিবস নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কোনো এলার্জি নেই।
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ও কলামিস্ট।