সিলেটে রেললাইন যেন মরণফাঁদ, আর কত দুঘর্টনা ঘটলে সরকারের টনক নড়বে?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৯:১২ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
সিলেটের রেললাইন লক্কড়ঝক্কড় হওয়ায় ঘন ঘন দুর্ঘটনা বাড়ছে। কোনোভাবেই দুর্ঘটনা থেকে রেহাই মিলছে না। গত ৬ মাসে ৭টি ট্রেন দুঘর্টনার শিকার হয়েছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও নামক স্থানে তেলবাহী ট্রেনের ১০টি বগি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনায় সিলেট অঞ্চলের ট্রেনযাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিবার দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পর শুরু হয় তোড়জোড়। চলে ঘটনার ময়নাতদন্ত। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি, এরপর যেই সেই। সরকারের পক্ষ হতে বলা হয় সিলেটে নতুন লাইন করতে প্রকল্প নেয়ার প্রক্রিয়াধীন। আশার বানীতেই দিন যাচ্ছেন সিলেটবাসীর। সবার প্রশ্ন আর কত দুঘর্টনা ঘটলে সরকারের টনক নড়বে? যদিও নতুন ট্রেনের বগি সংযোজন করা হয়েছে। কিন্তু ট্রেন দুর্ঘটনা কমছে না।
রেলওয়ে বিভিন্ন স্টেশন মাস্টারদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, সিলেট আখাউড়া সেকশনের রেললাইন ব্রিটিশ আমলের তৈরি। দীর্ঘকালের রেললাইন ও ব্রিজগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গত ৬ মাসে এ সিলেট সেকশনে সাতগাঁও, ফেঞ্চুগঞ্জ, কুলাউড়া, ভানুগাছ ও শ্রীমঙ্গল এলাকায় ৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে।
২০১৯ সালের জুনে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচালে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান চার যাত্রী ও আহত হন শতাধিক। প্রতিবছর সিলেট-আখাউড়া রেলপথে ১৫-২০টি ছোট ছোট দুর্ঘটনা ঘটছেই। ২০২০ সালে দীর্ঘদিন করোনার কারণে রেল চলাচল বন্ধ থাকলেও সে বছরের আগস্ট থেকে চালু হওয়ার পর থেকে চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তেলবাহী ট্রেনসহ ৭টি ট্রেন দুর্ঘটনাকবলিত হয়। গত ৬ ডিসেম্বর দুপুরে মাধবপুরের শাহাজীবাজার রেলস্টেশনের পাশে তেলবাহী ট্রেনের পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এ কারণে ১৩ ঘণ্টা সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকে। ১১ নভেম্বর সিলেট ও মৌলভীবাজারের মধ্যবর্তী ভাটেরায় মালবাহী ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এতে বন্ধ হয়ে যায় সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ। ৭ নভেম্বর সাতটি বগি নিয়ে শ্রীমঙ্গলে তেলবাহী একটি ওয়াগন লাইনচ্যুত হয়। এতে ২৩ ঘণ্টা বন্ধ থাকে রেল যোগাযোগ। একই স্থানে ২০১৮ সালে ১১টি বগি নিয়ে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর সিলেট রেলস্টেশনে ডকইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়িকা এক্সপ্রেসের সামনের দিকে ধাক্কা দেয় জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস। ১৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও এলাকায় তেলবাহী ওয়াগনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ২৩ আগস্ট যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয় কুলাউড়া এলাকায়। একই স্টেশনে গত ২৪ জানুয়ারীর ট্রেনের বগিতে আগুন ধরে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে এ রুটে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে গত বছরের ২৩ জুন। এদিন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল এলাকায় উপবন এক্সপ্রেসের পাঁচটি বগি সেতু ভেঙে ছড়ায় পড়ে যায়। এতে চারজন নিহত ও শতাধিক যাত্রী আহত হন। ২১ ঘণ্টা পর রেল চলাচল স্বাভাবিক হয়।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ১৭৯ কিলোমিটার আখাউড়া-সিলেট রেলপথের পুরোটাই জরাজীর্ণ। এই সেকশনে ৯০ শতাংশ সেতুই মেয়াদোত্তীর্ণ। তার মধ্যে এই রুটের সব ট্রেনের বগি-ইঞ্জিন অনেক পুরনো। বর্তমানে কিছুটা ভালো মানের বগি ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভানুগাছ স্টেশনের অপেক্ষামান যাত্রী হৃদয় আহমদ বলেন, সিলেটে আর কত দুর্ঘটনা ঘটলে রেললাইন মেরামত করা হবে। নতুন ইঞ্জিন সংযোজন করলেই হবে না, সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
সিলেট স্টেশনের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ি ও আঁকাবাঁকা সড়ক হওয়ায় আখাউড়া-সিলেট সেকশনের রশিদপুর থেকে মাইজগাঁও পর্যন্ত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আখাউড়া-সিলেট রেলপথে পারাবত, জয়ন্তিকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রতিদিন ১২-১৫ হাজার যাত্রী সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রামে যাতায়াত করেন। নির্মাণের ৫৫ বছর পর রেল সেতুর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এ রুটের সেতুর বয়স প্রায় শত বছরের কাছাকাছি। তালিকা অনুযায়ী ১৩টি সেতুকে ‘ডেড স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ সেতুর আগে ট্রেন থেমে যাবে, পরে ৫ কিলোমিটার গতিতে সেতু অতিক্রম করবে। সিলেট থেকে মোগলাবাজার স্টেশন পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৮টি ও মোগলাবাজার থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে ৫টি সেতু ‘ডেড স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনে আগে ট্রেন চলত ঘণ্টায় ৭০-৮০ কিলোমিটার গতিতে। এখন তা অর্ধেকে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ ৪০ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।
সিলেট রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার খলিলুর রহমান বলেন, ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁওয়ে সিলেটগামী তেলবাহী ট্রেনের ১০টি বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করতে দুটি টিম কাজ করে যাচ্ছে। তবে কুলাউড়া ও শ্রীমঙ্গল হতে ট্রেন চলাচল করছে।