সিলেটে পাকিস্তানি ডিসির নাম মুছতে চান মেয়র আরিফ
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ জানুয়ারি ২০২১, ১০:৪২ অপরাহ্ণ
নাম ছিল তাঁর আলী হাসান। বাড়ি ছিল তাঁর পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের অধীনে ছিল, সেই সময়ে, ১৯৫৮ সালের ২১ জানুয়ারি সিলেটের জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। দায়িত্বে ছিলেন ১৯৬০ সালের ২৭ আগস্ট অবধি।বাঙালির ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় এক অধ্যায়কে ঢেকে দিতে পাকিস্তানের ওই চতুর কর্তা সিলেটের গোবিন্দচরণ পার্কের জায়গায় ১৯৫৯ সালে নির্মাণ করেন ‘হাসান মার্কেট’।
আলী হাসানের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল অনেকটাই। বিপণি বিতানের ঝলমলে জগতের ভিড়ে আড়ালেই পড়ে গিয়েছিল গোবিন্দচরণ পার্ক আর এর সাথে জড়িয়ে থাকা ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি।তবে সেই গৌরবময় স্মৃতির ঝলক এবার ফিরে আসার অপেক্ষায়। সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী হাসান মার্কেট ও লালদিঘী সিটি সুপার মার্কেটের প্রায় ১৫ একর জায়গাজুড়ে একটি নান্দ্যনিক কমপ্লেক্স গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। যার নাম হবে ‘বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স’। এই কমপ্লেক্স গড়ে তোলার কাজ শুরু হলে মুছে যাবে সেই আলী হাসানের চতুরতার ইতিহাস।ইতিহাসের তথ্য বলছে, সিলেটের রায়নগরের বাসিন্দা ছিলেন গোবিন্দচরণ দাস। তিনি ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পরে সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন, তবে শিক্ষা অন্তঃপ্রাণ দুর্গাকুমার বসুর জন্য পদটি ছেড়ে দেন তিনি। গোবিন্দচরণ দাসের ছেলে গিরিশচন্দ্র দাস সিলেটের প্রথম প্রকৌশলী ছিলেন। তিনি কলকাতার হাওড়া ব্রিজ নির্মাণের সাথেও জড়িত ছিলেন। গোবিন্দচরণের স্মৃতি ধরে রাখতে সিলেট শহরের বন্দরবাজারে পার্ক নির্মাণ করেন গিরিশচন্দ্র। সেটির নাম রাখেন ‘গোবিন্দচরণ পার্ক’।
পরবর্তীতে এই পার্ক জড়িয়ে যায় বিভিন্ন ন্যায্য আন্দোলনের সাথে। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের সাথে গোবিন্দচরণ পার্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের শুরুর দিকে, ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও ১১ মার্চ সারাদেশে ধর্মঘটের ডাক আসে। এই কর্মসূচির মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ৮ মার্চ তমদ্দুন মজলিশ ও মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের উদ্যোগে গোবিন্দচরণ পার্কে জনসভার আহবান করা হয়। সেই সভায় হামলা চালায় মুসলিম লীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১০ মার্চ প্রতিবাদ সভার আহবান করা হয়। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে দুই মাসের জন্য সিলেটে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। বাংলাদেশের গৌরবের ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে থাকা গোবিন্দচরণ পার্কের স্মৃতি আড়াল হয়ে যায় ওই জেলা প্রশাসক আলী হাসানের চতুরতায়। তিনি গোবিন্দচরণ পার্কের স্থলেই নির্মাণ করেন হাসান মার্কেট। অবশেষে সেই হাসান মার্কেট আর পাশর্^বর্তী লালদিঘী সিটি সুপার মার্কেটের জায়গায় ‘বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স’ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। অত্যাধুনিক এই কমপ্লেক্সে থাকবে বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা। ‘বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স’ নির্মাণে নকশা প্রণয়নের কাজ করেছে ট্রায়াঙ্গল কনসালট্যান্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এর সাথে জড়িত স্থপতি শাকুর মজিদ।সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স হবে প্রায় ১৫ একর জায়গাজুড়ে। হাসান মার্কেট ও লালদিঘী সিটি সুপার মার্কেটের জায়গায় এই কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হবে। এখানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা থাকবে। দৃষ্টিনন্দন নাগরিক চত্বর রাখা হবে।কমপ্লেক্সের মধ্যে থাকবে ‘বঙ্গবন্ধু চত্বর’। যেখানে ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতীকী উপস্থাপনা থাকবে।ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আঙুল উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তাঁর সেই উঁচু অঙ্গুলির আদলে এই কমপ্লেক্সে ভাস্কর্য নির্মাণ করা হবে। থাকবে ‘বঙ্গবন্ধু প্লাজা’, সুউচ্চ ভবন। যেখানে সিনেপ্লেক্স, অডিটোরিয়াম, ১ হাজার আসনের কনভেনশন হল, মুক্তিযুদ্ধের দালিলিক স্মারক সংগ্রহশালা রাখা হবে।কমপ্লেক্সে থাকবে খোলা পার্ক, বইমেলা বা কুঠিরশিল্প মেলা করার জন্য ৩৪২টি স্টল বসানোর সুবিধা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার জন্য উন্মুক্ত মঞ্চ রাখা হবে।হাসান মার্কেট ও লালদিঘী সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের জন্য ৬ তলাবিশিষ্ট মার্কেট নির্মাণ করা হবে।‘বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্সে’র ল্যাম্পপোস্টগুলো হবে সিলেটের ঐতিহ্য দুটি পাতা-একটি কুঁড়ির আদলে।সুত্র-সিলেটভিউ