ইতিহাস গড়ছেন নিউইয়র্ক সিটি পুলিশের বাংলাদেশি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৫০:৫৫,অপরাহ্ন ২৯ জানুয়ারি ২০২১
সুরমা নিউজ:
এই প্রথম দক্ষিণ এশিয়দের মধ্যে প্রথম কোন বাংলাদেশি নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ (এনওয়াইপিডিতে) শীর্ষ পদে আসিন হয়েছেন। লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হিসেবে বাংলাদেশি লেফটেন্যান্ট শামসুল হক এনওয়াইপিডিতে গোয়েন্দা স্কোয়াডে যুক্ত হয়েছেন। যা দক্ষিণ এশিয় এবং বাংলাদেশিদের মধ্যে একটি ইতিহাসে অধ্যায়। তাইতো উচ্ছ্বসিত আমেরিকান বাংলাদেশি কমিউনিটি।
সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেই আগামি ২৯ জানুয়ারি শুক্রবার নিউইয়র্কের কুইন্সে এনওয়াইপিডির পুলিশ একাডেমিতে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশি লেফটেন্যান্ট শামসুল হকের অভিষেক হচ্ছে। এরপর থেকেই তিনি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
বাংলাদেশি শামসুল হকের ক্যারিয়ার:
২০০৪ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম “ফাইনেস্ট ল’এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি” নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ তথা এনওয়াইপিডিতে যোগদান করেন শামসুল। ওইসময়ে মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশে অফিসার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এরপর ২০১০ সালে তাকে সার্জেন্ট পদে পদোন্নতি দিয়ে সিটির ব্রঙ্কসে বোরোতে পাঠানো হয়। ২০১৪ সালে লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। এরপর বাংলাদেশি-আমেরিকান শামসুল হক এনওয়াইপিডির অভিজাত অভ্যন্তরীণ বিষয়ক তদন্ত গ্রুপে যোগদান করেন।
আমেরিকান পুলিশ তথা সিটির গোয়েন্দা স্কোয়াডে প্রথম কোন দক্ষিণ এশিয় লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হিসেবে এবার যুক্ত হচ্ছেন এই বাংলাদেশি। নিউইয়র্ক সিটিতে ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছন তিনি। কমিউনিটির গণমাধ্যমকে লেফটেন্যান্ট শামসুল হক নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, “যদিও আমি প্রথম এই কীর্তি গড়েছি, আমি আশাবাদী, এই পদে ভবিষ্যতে আরো অনেক বাংলাদেশিকে দেখবে আমেরিকানরা।”
চ্যানেল টিটির সাথে আলাপকালে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার শামসুল হকের সহপাঠিরা বলেন, “আমাদের বিশ্বাস কেবল তিনিই নন; একদিন লাল-সবুজের বাংলাদেশ আমাদের আরো অনেককেই নিয়ে গর্ব করবে। আমেরিকান বিভিন্ন সংস্থায় বাংলাদেশিরা সুনামের সহিত কাজ করছে। এটাই আমাদের অনেক অর্জন।”
সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, “বাংলাদেশি আরো অনেকেই এনওয়াইপিডির শীর্ষ পদে রয়েছে। তবে, দেশিয় রাজনীতি এখানে না থাকলে কেবল পুলিশে নয়, মূলধারার রাজনীতিতেও অনেকদুর যেতে পারতো বাংলাদেশি অভিবাসিরা।”
স্বপ্নের দেশে শামসুল হকের পথচলা:
১৯৯১ সালে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসিদের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান শামসুল হক। এখানে এসে তিনি অনেক পরিশ্রমের কাজ করেন। এমন কোন ‘অড-জব’ নেই যে তিনি করেন নি। জানা গেছে, বাস-বয় থেকে শুরু করে ডেলিভারি ম্যান, ম্যানেজারসহ নানা চাকরি করেছিলেন। পাশাপাশি ভবিষ্যতে ভালো কিছু করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে তিনি পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। যার পুরস্কার হিসেবে ১৯৯৭ ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। ধাপে ধাপে নিউইয়র্ক সিটির কমিউনিটি কলেজ লাগার্ডিয়া কলেজ থেকে এএস এবং বারুক কলেজ থেকে বিবিএ (ব্যাচেলর ডিগ্রি) পাশ করেন।
বারুক কলেজে পড়াশোনার সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সিএনইওয়াই ট্রাস্টির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর তিনি উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যান। আমেরিকার অন্যতম প্রখ্যাত বিদ্যাপীঠ ‘কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয’ থেকে জনপ্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
কেন বেছে নিলেন পুলিশে চাকুরি?:
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে সন্ত্রাসি হামলার ঘটনা ঘটে। ওই সময়ে নানা হয়রানিল শিকার হয় আমেরিকান মুসলিম কমিউনিটি। একের পর এক মুসলমানরা বর্ণবাদের মুখে পড়েন। অনেকে নাজেহাল হওয়ার খবর ছিল নিত্যদিনের। ওই সময়ে বর্তমান লেফটেন্যান্ট শামসুল হক সিদ্ধান্ত নেন তিনি পুলিশ বিভাগে যোগ দেবেন। নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ‘এনওয়াইপিডিতে’ যোগদান করেন তিনি। মেধা ও দক্ষতা দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এরপর শামসুল হক বুঝতে পারেন যে আরও বেশি সংখ্যক আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি আমেরিকানদের প্রয়োজন।
এ জন্য তিনি আরও বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি আমেরিকান অফিসারকে আহ্বান জানান উক্ত পেশায় যোগদানে। তিনি ও তার গুটি-কয়েক সহপাঠিদের সহায়তায় গঠিত হয়- “বাংলাদেশি আমেরিকান পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন-বাপা” (এনওয়াইপিডি-বাপা) নামের এ সংগঠনটি এখন কমিউনিটির নানা সেবামূলক কাজেও নিয়োজিত।
শুরুর দিকে লেফটেন্যান্ট শামসুল হক সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে সংস্থাটি এনওয়াইপিডিতে ‘ট্রাফিক অ্যানফোর্সমেন্ট এজেন্ট’ এবং ‘পুলিশ অফিসার’ পদে শত শত বাংলাদেশিকে নিয়োগে সহায়তা করে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৪ শতাধিত বাংলাদেশি নিউইয়র্ক সিটি পুলিশে কর্মরত। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই কর্মকর্তা, গোয়েন্দা, সার্জেন্ট রয়েছেন। এছাড়া ৩ জন লেফটেন্যান্ট এবং ৩ জন অধিনায়ক রয়েছেন। পাশাপাশি এনওয়াইপিডি দ্বারা নিযুক্ত সহস্রাধিক ট্রাফিক এজেন্ট রয়েছেন। যারা সিটির ট্রাফিকিং এবং টিকেটিং ব্যবস্থায় সুনামের সাথে কাজ করছেন।
‘এনওয়াইডপিডির’ উচ্চ পদে প্রথম বাংলাদেশি খন্দকার আবদুল্লাহ:
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশি-আমেরিকান খন্দকার আবদুল্লাহ পুলিশের উচ্চপর্যায়ের নির্বাহী পদে যোগ দিয়েছেন। বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ও শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী হিসেবে পরিচিত এনওয়াইপিডির ক্যাপ্টেন পদে যোগদান করেছেন ৩৩ বছর বয়সী খন্দকার আবদুল্লাহ।
ক্যাপ্টেনের পর নিউইয়র্ক পুলিশের পরের ধাপের পদবি পুলিশ কমিশনার, যা রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। যদি নিউইয়র্কের সিটি হলে বাংলাদেশি আইনপ্রণেতা থাকতো তাহলে হয়তো কোন বাংলাদেশির নাম উঠে আসতে সিটির পুলিশ কমিশনার হিসেবে।
এছাড়া, নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগের (এনওয়াইপিডি) নির্বাহী কর্মকর্তা ‘ক্যাপ্টেন’ হয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন কারাম চৌধুরী। যিনি ছিলেন বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার তিলাগাঁও গ্রামের বাসিন্দা। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসি কারাম চৌধুরী ছাড়াও নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ বিভাগের নির্বাহী কর্মকর্তার এই পদে আরো তিনজন বাংলাদেশি-আমেরিকান পদোন্নতি পেলেন।
এর আগে কারাম চৌধুরীর খালাতো ভাই সিলেটের আরেক সন্তান মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ এবং পারোল আহমেদ ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতির তালিকায় ছিলেন বাংলাদেশি-আমেরিকান মিলাদ খান। ফলে, এনওয়াইপিডিতে বাংলাদেশি অফিসারদের একের পর এক সাফল্যে দারুণ খুশি বাংলাদেশি কমিউনিটিও।
তারও আগে বাংলাদেশি-আমেরিকান পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুমন সৈয়দ লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। যদিও তিনি বর্তমানে অবসরে আছেন। সার্জেন্ট পদে দায়িত্ব পালন করে সুমন বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন এনওয়াইপিডিতে।
শামসুল হক, সুমন সৈয়দ,কারাম চৌধুরী, আবদুল্লাহরা যখন অন্যদের অনুপ্রেরণা:
উল্লেখ্য, লেফটেন্যান্ট শামসুল হক কিংবা খন্দকার আবদুল্লাহদের মতো পুলিশের শীর্ষ পদে আসিন হওয়া আরো একাধিক বাংলাদেশির বিরাট সাফল্যে গর্বিত কমিউনিটি। বাংলাদেশি-আমেরিকান কমিউনিটির পাশাপাশি তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে- ’চ্যানেল টিটি’ পরিবার। এরই মধ্যে ‘বাংলাদেশি আমেরিকান পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন-বাপার’ পক্ষ থেকেও তাদের প্রিয় সহযোদ্ধা শামসুল হককে অভিনন্দন জানানো হয়েছে।
শামসুল হকে শৈশব-কৈশর:
জানা গেছে, লেফটেন্যান্ট শামসুল হকে গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেটে জেলায়। সেখান গোলাপগঞ্জের বাঘার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার বাবা প্রয়াত আবদুল মুসাব্বির এবং মা প্রয়াত নুরুন নেছা। স্ত্রী রুবিনা হক ও দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি বর্তমানে নিউইয়র্কের কুইন্সের অধিবাসি। তার অন্যান্য ভাই-বোনেরাও নিউইয়র্কের বাসিন্দা।