লন্ডনে মৃত্যুর মিছিলে সিলেটিরা: বন্ধ আয়ের পথ, দুশ্চিন্তায় স্বজনরা
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:১১:০১,অপরাহ্ন ২৫ জানুয়ারি ২০২১
1.7K - 1.7KShares
সুরমা নিউজ:
নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে চরম দুঃসময় পার করছে যুক্তরাজ্য। প্রতিদিন মৃতের তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। আর সেই মৃত্যুর মিছিলে নাম উঠছে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও।
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রবাসীদের দিন শুরু হচ্ছে আপনজন বা কমিউনিটির কারো মৃত্যুর সংবাদ শুনে অথবা করোনা আক্রান্তের সংবাদে। বিপর্যস্ত যুক্তরাজ্যে সংক্রমণ রুখতে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সেখানকার প্রবাসী বাঙালিদের আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেছে।
জানা যায়, দেশটিতে করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক নতুন ধরনের কারণে পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ চলে গেছে। সেখানকার হাসপাতালগুলোতে রোগীর উপচেপড়া ভিড়। করোনায় প্রতিদিন মৃত্যুর রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। মৃতের সংখ্যা এতটাই বাড়ছে যে, লন্ডন শহরের মুসলিম কবরস্থানগুলোতে মরদেহ সমাহিত করার জন্য লাইন ধরতে হচ্ছে। মেশিনে মাটি কেটে একের পর এক মরদেহ দাফন করা হচ্ছে। মর্গগুলোতে লাশের সারি। কিছু কিছু জায়গায় প্রতি ২০ জনে একজনের শরীরে ভাইরাস সংক্রমিত হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসেও বেড়ে গেছে চাপ। দিনেই আসছে প্রায় ৯ হাজার কল।
ব্রিটেনে এই দফার করোনা সংক্রমণের ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। মারা গেছেন কমিউনিটির পরিচিত অনেক মানুষ। প্রতিটি পরিবারে কেউ না কেউ করোনায় আক্রান্ত। যে কমিউনিটিতে বছরে ৩৬৫ দিনই লেগে থাকতো পারিবারিক-সামাজিক অনুষ্ঠান, মেলা, রাজনৈতিক সভা। সেই কমিউনিটি এখন নিথর, প্রাণশক্তিহীন। স্বজন ও পরিচিতদের মৃত্যু ও আক্রান্তের খবরে সবাই শোকাহত। একই সঙ্গে বাড়ছে বেকারত্ব, বাড়ছে আর্থিক সংকটও। এতে করে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন ব্রিটেনের ৮ লক্ষাধিক বাংলাদেশি।
সংক্রমণের লাগাম টানতে ৪ঠা জানুয়ারি থেকে ফের লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। যুক্তরাজ্য এরই মধ্যেই ফাইজার/বায়োএনটেক এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা অনুমোদন করেছে। শুরু হয়েছে টিকাদান কর্মসূচি। তৃতীয় টিকা হিসেবে দেশটিতে মডার্নার টিকাও অনুমোদন পেয়েছে। এরপরও এখনও আক্রান্ত ও মৃতের দিক দিয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে দেশটি।
বাঙালি প্রবাসীরা বলছেন, ব্রিটেনে যেসব বাংলাদেশি ব্যবসা করেন তাদের ৮০ শতাংশই রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। করোনা মহামারি এই ব্যবসায় ধস নামিয়েছে। এছাড়া নাইট ক্লাব, পাব সবকিছু বন্ধ থাকায় যারা ট্যাক্সি চালাতেন তাদের আয়ও কমে গেছে। ব্রিটেনের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য অনুযায়ী করোনায় ২০২০ সালে প্রায় ১৬ লাখ ৯০ হাজার মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। সরকার এখন পর্যন্ত ফার্লো স্কিমের (বিশেষ কর্মসূচি) মাধ্যমে দেশটির কর্মজীবীদের বেতনের বড় অংশ পরিশোধ করে যাচ্ছে।
এদিকে, গত কয়েক সপ্তাহে যুক্তরাজ্য ছেড়েছেন বিপুল সংখ্যক অভিবাসী। দেশত্যাগের এই স্রোত এতটাই তীব্র যে, ধারণা করা হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই ব্রিটিশদের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা কমার ঘটনা। সাম্প্রতিক এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ব্রিটিশ থিংক ট্যাঙ্ক স্ট্যাটিসটিকস সেন্টার অব এক্সিলেন্স জানিয়েছে, ২০১৯ সালের জুন থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৩ লাখেরও বেশি বিদেশি যুক্তরাজ্য ছেড়েছেন।
স্থানীয় কমিউনিটি সূত্রে জানা যায়, করোনায় বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদে মৌলবীবাজার-রাজনগর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য তোয়াবুর রহিম, লাইফ মেম্বার বাংলাদেশ সেন্টারের হারুনুর রশিদ , ব্যবসায়ী কামাল জাহাঙ্গীর মিয়া, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আলহাজ্ব হাফিজ মজির উদ্দিন, আলহাজ্ব সৈয়দ আব্দুর রহমান, মুজিবুর রহমান চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক, কমিউনিটি নেতা আব্দুস সালিক, খালেদ চৌধুরী, আলহাজ্ব উস্তার আলী, বিয়ানীবাজার ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্টের সাবেক সভাপতি রউফুল ইসলাম, নাজিম আহমদ, ওল্ডহ্যাম বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের সভাপতি এম এ মান্নান, এনামুল হক, ড. মামুন রহমান, গোলাম আবু সালেহ শুয়েব, বাংলা টাউনের সমাজকর্মী তছির আলী, খলিলুর রহমান, সোনালী অতীতের ফুটবলার আখলিছ, বদরুল আমিন, সমাজসেবী মজুমদার আলী, সিলেটের বিশ্বনাথের সিরাজ উদ্দিন, শোয়েব খালিছাদার, ডার্বির সমাজসেবী হারুন মিয়া, কিলবার্নের আব্দুল কাদির, কবি দেওয়ান হাবিব চৌধুরী, রাজনীতিবিদ আবু লেইস মিয়া ও তার আপন ভাই আকদ্দছ আলী, ইনাতগঞ্জের আবুল বশর, ছৈলার আবু শাহাদাত কালাই, ব্যবসায়ী আব্দুল বাতিন, কাজী আবু খালেদ, সোয়ানসীর দুই ভাই কবির উদ্দিন ও বদরুল ইসলাম, ফেঞ্চুগঞ্জের কবির মিয়া, নিউহ্যামের আলম, সিলেটের সাবেক ফুটবলার লন্ডনের ব্রমলি-বাই-বও এলাকার আবুল করিম হাসনুসহ অনেকের মৃত্যু হয়েছে।
সিলেটের লন্ডন প্রবাসী জাকির আহমদ বলেন, ‘নতুনভাবে সংক্রমণ বাড়ায় প্রবাসীরা বিপর্যস্ত। প্রতিদিন পরিবারের কেউ না আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া বাঙালি কমিউনিটিতে বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। আমার প্রবাস জীবনে এত মানুষের মৃত্যুর খবর কখনও শুনিনি। অনিশ্চিত দিন কাটছে। সকাল শুরু হচ্ছে মৃত্যুর সংবাদ আর করোনা আক্রান্তের খবর দিয়ে। বিছানায় যাই একই দুঃখের সংবাদ মনের ভেতরে জমা করে। এখানে এত বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন, কেউ মারা গেলে তার লাশ হাসপাতালে ৩-৪ দিন পড়ে থাকছে। কবরের ব্যবস্থাপনা করাও এখন অনেক কষ্টকর।’
জাকির আহমদ আরও বলেন, ‘একদিকে মৃত্যু অন্যদিকে বাড়ছে আর্থিক সংঙ্কটও। কারণ যুক্তরাজ্যে বলবৎ রয়েছে কঠোর লকডাউন। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ লকডাউনের জন্য জরুরি প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব বন্ধ। এছাড়া যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তারাও আছেন বিপাকে। তবে সরকার সহায়তা করছে।’
আরেক যুক্তরাজ্য প্রবাসী তারেক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা একটি কঠিন সময় পার করছি। প্রতিদিন কারো না কারো মৃত্যুর সংবাদ পাচ্ছি। করোনায় প্রতিদিন মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য। তবে সবচেয়ে বেশি শঙ্কা আমাদের বাবা-মা এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের নিয়ে। কারণ তারা এমনিতেই অনেক রোগে আক্রান্ত।’
ইউকে বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি কে এম আবু তাহের চৌধুরী বলেন, ‘বাঙালির ঘরে ঘরে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। এক ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। আমরা কেউই ভালো নেই। প্রতিটি পরিবারে কেউ না কেউ করোনায় আক্রান্ত। হাসপাতালে ঠাঁই নেই। করোনায় প্রতিদিন মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য।’
উল্লেখ্য, ওর্য়াল্ড মিটারের হিসেবে যুক্তরাজ্যে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩৬ লাখ ১৭ হাজার ৪৫৯ জন। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৯৭ হাজার ৩২৯ জন। সর্বশেষ গত শুক্রবার নতুন করে ১ হাজার ৪০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার ১ হাজার ২৯০ জনের মৃত্যু হয়েছে, বুধবার মারা গেছেন ১৮২০ জন, মঙ্গলবার ১,৬১০ জনের মৃত্যু হয় এবং আর শুক্রবার নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৪০ হাজার ২৬১ জন।
সূত্র: সিলেট মিরর
1.7K - 1.7KShares