সিলেটের অজানা ইতিহাস
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জানুয়ারি ২০২১, ৫:৩৬ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
ইতিহাস কথা কয়! চারদিকে ইতিহাস বিকৃত করার মহোৎসব…! ইতিহাস ধ্রুব সত্য। চাপা দিয়ে রাখা যায়, বিকৃত করা যায়, কিন্তু ধ্বংস? নৈবচ, নৈবচ। যার কোনো ইতিহাস নেই, ইতিহাস নিয়ে তাঁর দায়ও নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক কিছুই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। উপেক্ষা করা হয়েছে আঞ্চলিক ইতিহাসকে। একটি বৃহত্তর ভূখণ্ডে আঞ্চলিক ইতিহাসের সমন্বয়েই গড়ে ওঠা উচিত বৃহত্তর জাতীয় ইতিহাস। কিন্তু আমাদের এখানে তা আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত, উপেক্ষিত।
আমাদের জাতীয় ইতিহাসে বাঁশের কেল্লার তিতুমীর পাই। পাই দেবী চৌধুরানী, রাধারাম আর গঙ্গা সিংহকে। কিন্তু পাওয়া যায় না সিলেটের হাদা মিয়া, মাদা মিয়া, আগা মুহাম্মদ রেজা বেগ, রাব্বী চৌধুরী ও সৈয়দ রিয়াজুর রহমানসহ অনেক ছোটবড় মুসলমান জমিদারকে। যারা গরিব রায়তদের পক্ষ নিয়ে কোম্পানিকে অন্যায্য খাজনার দাবি মেটাতে অস্বীকার করেছিলেন। ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।
আসলে সিলেট বা শ্রীহট্টের ইতিহাস গতানুগতিক প্রাচীন বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশ হতে ভিন্ন। কারণ বঙ্গীয় ব-দ্বীপের ভৌগোলিক ভিন্নতার কারণে। পাহাড়/টিলা, বিশাল হাওর ও অসংখ্য নদ-নদী এই ভূ–ভাগকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। দুর্গমতার কারণে এই বিভাগটা ছিল শাসক শ্রেণির মাথা ব্যথার কারণ। আরেকটা কারণ হলো, বৃহত্তর বঙ্গদেশ হতে বারবার বিচ্ছিন্নতা। ১৯০৫ সালে একবার বঙ্গদেশের সঙ্গে জুড়ে দিলেও ১৯১১ সালে আবার আসামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। সবশেষে ১৯৪৮ সালে আবার পাকিস্তানে আসে।
প্রাচীন ইতিহাস আলোচনায় যাব না। ১৩০৪ সালে হজরত শাহজালাল (র.)–এর শ্রীহট্ট জয়ের মাধ্যমে এই জনপদ পাদপ্রদীপের আলোয় আসে। এই মহান সাধকই সিলেটে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরই অনুসারীরা একে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে শাসন করতে থাকেন। ১৫৭৬ সালে সম্রাট আকবরের সময় বঙ্গদেশ মোগল শাসনের অধীন হলে সিলেটও অন্তর্ভূত হয়। ১৫৮২ সালে পুরো বঙ্গদেশ ১৯টি সরকার ও ৬৮২টি পরগনায় ভাগ করা হয়। পাঠান আমলের ইতিহাসও সিলেটে ছিল বলে জানা যায়। মোগল ও পাঠানরা ফৌজদারদের মাধ্যমে সিলেটের শাসন চালাতেন।
১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের পর এ দেশে ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়। ১৭৬৫ সালে কোম্পানি শাসনের অধীনে আসে সিলেট। ঢাকার অধীনেই সিলেটের শাসন কাজ চলত। একজন কালেক্টর ছিলেন সিলেটের প্রধান নির্বাহী। মি. থ্যাকারে ছিলেন এখানকার প্রথম কালেক্টর। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বেশ কয়েক বছরের মধ্যেই এরা সিলেটের মুসলমান জমিদারদের রোষানলে পড়লেন।
কারণ মুসলমান জমিদারেরা কোনোক্রমেই ইংরেজ শাসন বরদাশত করতে রাজি ছিলেন না। তৃতীয় কালেক্টর রবার্ট লিন্ডসে প্রথম সশস্ত্র বিরোধিতার মুখে পড়েন। শ্রীহট্টের মুসলমানেরা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম রুখে দাঁড়ান। ১৭৮২ সালে শ্রীহট্ট শহরের শাহি ঈদগাহ ময়দানে কালেক্টর লিন্ডসে দুজন মুজাহিদ বীরের মুখোমুখি হন। হাদা মিয়া ও মাদা মিয়া নামে এই দুজন প্রকাশ্যে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেন।
লিন্ডসে লিখেছেন, ‘Then I went forward, their leader a preist of considerable rank at to the head of three hundreds men. He immediately opened his sword & exclaiming with a loud voice “this is the day to kill or die, the reign of the English is at an end”.
ভাবুন তো একবার কত দুঃসাহসিক কাজ! অবশ্য সেই ক্ষণস্থায়ী অসম যুদ্ধে তাঁরা উভয়ই শাহাদত বরণ করেছিলেন। এই প্রতিবাদটা ছিল তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার যুদ্ধের (১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দ) ৪৯ বছর আগে। এই ইতিহাস কোথাও নেই…!
এর আগে ইংরেজ শাসনে খাজনা আদায়ে অস্বীকৃতি জানান তরফের জমিদার সৈয়দ রিয়াজুর রহমান। ১৭৭০ সালে মোগল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের খেতাবপ্রাপ্ত ‘চৌধুরী’ ছিলেন তিনি। গরিব মুসলমান রায়তদের ওপর জবরদস্তিমূলক খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধাচরণ করেন এই সাহসী জমিদার। শুধু তাই নয়, অন্য জমিদারদের সংগঠিত করে তিনি কোম্পানির নিলাম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। কোম্পানির নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে কি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম বলা অসমীচীন? কারণ, ওই সময় তো আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়েছিল। এই ঘটনা কী জাতীয় ইতিহাসে স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়?
ইতিহাসবিদ ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, ‘নবাবি প্রতিরোধের ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক এলিটের প্রতিরোধমুখী চেতনার উদাহরণ হিসেবে সিলেটের আগা মুহাম্মদ রেজা ও ঢাকার নবাব শামসুদ্দৌলার কথা উল্লেখ করা যায়। সিলেটের আগা মুহাম্মদ রেজা বেগ একজন স্বনির্বাসিত মোগল ছিলেন, যিনি ১৭৯৯ সালে “ফিরিঙ্গি হুকুমত” থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সবাইকে তাঁর সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী জেহাদে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান।’ (বাংলাদেশের ইতিহাস, ১৭০৪-১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ, প্রথম খণ্ড, পৃ.১০২, এশিয়াটিক সোসাইটি)
শুধু তাই নয়, আগা মুহাম্মদ সিলেটের অদূরে কাছাড়ের পাহাড়ি এলাকায় সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। পার্শ্ববর্তী তরফ ও অন্য জমিদার ও এলিটের কাছে উদ্দীপনামূলক চিঠি পাঠিয়ে সাহায্য কামনা করেন। তাদের মধ্যে সৈয়দ রিয়াজুর রহমানও ছিলেন। এই কারণে আগা মুহাম্মদ রেজা বেগের বিচার হয়েছিল। এই বিবরণও জাতীয় পাঠ্য ইতিহাসে স্থান পায়নি।
ইতিহাসে যাঁরা পালন করে গেছেন গৌরবময় ভূমিকা, তাঁদের স্মরণ করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। তবে এ কথা ঠিক, দ্রোহের আগুন বয়ে চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এই ধারাবাহিকতা আমরা দেখি সৈয়দ রিয়াজুর রহমানের উত্তরসূরিকে। তিনি প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ হাবিবুর রহমান, যিনি কর্মজীবনে ছিলেন আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর অফিসার। ১৯২ বছর পর তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেন। হবিগঞ্জ শহরে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়েছিলেন। ইতিহাস কী তাদের মনে রেখেছে? এঁদের অবদান ইতিহাসে গ্রন্থিত ও যথাযথ মূল্যায়ন করা সময়ের দাবি।