ছাত্রলীগের দলবদ্ধ ধর্ষণ: দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো বেড়াতে যাওয়া, যা ঘটেছিল…
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ৯:৫৫ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ :
সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার তরুণীর বিয়ে হয়েছিল কিছুদিন আগে। শুক্রবার ছুটির দিনে ঘুরতে বের হন স্বামীর সঙ্গে। ঘুরতে ঘুরতে তারা যান এমসি কলেজে। সেখানে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার তরুণী এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, আতঙ্কিত।
শুক্রবার রাত ১১টার দিকে ধর্ষণের এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তরুণীর স্বামী বাদী হয়ে শনিবার ছয় আসামির নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা আরো তিনজনকে আসামি করে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের শাহপরান থানায় মামলা করেন।
মামলার আসামিরা ছাত্রলীগের ‘সক্রিয় কর্মী’ বলে পুলিশ ও দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে। করোনা মহামারির কারণে বর্তমানে কলেজের ছাত্রাবাস বন্ধ থাকার পরও তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ছাত্রাবাসে বসবাস করে আসছিল বলে জানা গেছে।
মামলার আসামিরা হলেন সাইফুর রহমান (২৮), তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), শাহ মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), অর্জুন লস্কর (২৫), রবিউল ইসলাম (২৫) ও মাহফুজুর রহমান মাসুম (২৫)। এদের মধ্যে তারেক ও রবিউল বহিরাগত এবং অন্যরা এমসি কলেজের সাবেক ও বর্তমান ছাত্র। শাহপরান থানার ওসি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী মামলা দায়েরের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, মামলায় অজ্ঞাতনামা আরো তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
তবে শনিবার এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো আসামি ধরা পড়েনি।
আসামিদের মধ্যে সাইফুর রহমানের বাড়ি সিলেটের বালাগঞ্জে ও বর্তমান ঠিকানা এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়কের বাংলো বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শাহ মাহবুবুর রহমানের বাড়ি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বেগুনিপাড়ায় ও বর্তমান ঠিকানা ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের ২০৫ নম্বর কক্ষ, মাহফুজুর রহমানের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার গাছবাড়ি গ্রামে, রবিউলের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার জগদল গ্রামে, অর্জুনের বাড়ি জকিগঞ্জের আটগ্রামে এবং তারেকের বাড়ি সুনামগঞ্জ শহরের হাসাননগর এলাকায়।
এদের মধ্যে সাইফুর, রনি ও মাহফুজুর এমসি কলেজের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র এবং অর্জুন এমসি কলেজের সাবেক ছাত্র।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ধর্ষণের শিকার তরুণী সদ্য বিবাহিতা। তার বাড়ি সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলায়। দক্ষিণ সুরমার এক তরুণের সঙ্গে কিছুদিন আগে তার বিয়ে হয়। শুক্রবার বিকেলে নিজেদের গাড়িতে করে স্বামীর সঙ্গে তিনি বেড়াতে বের হন। গাড়ি চালাচ্ছিলেন তার স্বামী। সন্ধ্যার দিকে তারা এমসি কলেজ এলাকায় ঘুরতে যান। এরপর কলেজ ছাত্রাবাসের প্রধান ফটকের সামনে গাড়ি দাঁড় করে স্বামী প্রয়োজনীয় কেনাকাটার জন্য পাশের একটি দোকানে যান। এ সময় পাঁচ-ছয়জন যুবক তরুণীকে ঘিরে ধরে। স্ত্রীর চিৎকার শুনে স্বামী দৌড়ে সেখানে যান। তখন যুবকরা ওই তরুণ-তরুণী স্বামী-স্ত্রী কি না এমন প্রশ্ন এবং চাঁদা দাবি করে। একপর্যায়ে তারা ওই দম্পতিকে গাড়িসহ ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকে নিয়ে যায়। সেখানে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হয়। ঘণ্টাখানেক পর স্বামীকে ছেড়ে দিলে তিনি স্ত্রীকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখতে পান।
ছাত্রাবাস এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, নারীকণ্ঠের চিৎকার শুনে আশপাশের কিছু লোক ও ছাত্রাবাসের স্টাফ কোয়ার্টার থেকে শিক্ষক ও কর্মচারীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীকে কান্নাকাটি করতে দেখেন। এরপর পুলিশে খবর দেওয়া হয়। রাত ১২টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। এ সময় একটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়। পরে তরুণীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউনুছুর রহমান জানান, শনিবার দুপুরে তরুণীর চিকিৎসার খোঁজ নিয়েছি। তরুণী শারীরিকভাবে ঝুঁকিমুক্ত রয়েছেন। তবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও আতঙ্কিত অবস্থায় রয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন।
ঘটনার পর শুক্রবার গভীর রাতে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকে ছাত্রলীগের কক্ষ হিসাবে পরিচিত একটি কক্ষ থেকে দা’সহ কিছু দেশীয় অস্ত্র ও একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ছাত্রাবাসের ওই কক্ষের আবাসিক ছাত্র সাইফুর রহমানকে আসামি করে মামলা করেছে। তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের করা মামলায়ও সাইফুর রহমান অন্যতম আসামি।
এমসি কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমদ জানান, ছাত্রাবাসের ভেতরে ধর্ষণের ঘটনায় শনিবার কলেজে জরুরি সভা করা হয়। সভায় ঘটনা তদন্তে কলেজের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
শাহপরান থানার ওসি আবদুল কাইয়ুম বলেন, ধর্ষণকারীদের ধরতে শুক্রবার মধ্যরাত থেকেই অভিযান চলছে। শনিবার ভোররাতে ছাত্রাবাসে অভিযান চালিয়ে আসামি সাইফুর রহমানের কক্ষ থেকে একটি পাইপগান, চারটি রাম দা, একটি চাকু ও দু’টি লোহার পাইপ জব্দ করা হয়েছে।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘শনিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে পুলিশের বিভিন্ন দল কাজ করছে। আশা করছি দ্রুতই তারা ধরা পড়বে।’
আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘অপরাধীর অন্য কোনো পরিচয় নেই, সে অপরাধীই। অন্য কোনো পরিচয়ে ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই।’
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা জানান, ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্তরা এমসি কলেজ ও টিলাগড়কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের একটি পক্ষের সক্রিয় কর্মী। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক রনজিত সরকারের অনুসারী হিসাবে তারা পরিচিত। টিলাগড়ে ছাত্রলীগের আরো বিভিন্ন পক্ষ রয়েছে। এসব পক্ষের অনেকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, সন্ত্রাসের অভিযোগ রয়েছে। গত মে মাসে টিলাগড়ে সরকারি পশু খামারে গিয়ে রনজিত অনুসারীদের কয়েকজন বিনা মূল্যে ছাগল দিতে বলে। এতে রাজি না হওয়ায় ওই কার্যালয়ের কর্মকর্তাকে তারা মারপিট করে। শুক্রবার রাতে ধর্ষণ ঘটনায় জড়িতরাও রনজিত গ্রুপের সক্রিয় কর্মী।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানার জন্য রনজিত সরকারের মোবাইল ফোনে একাধিক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, ঘটনাটির নিন্দা জানানোর ভাষাও জানা নেই। যে বা যারা ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের গায়ে কলঙ্ক লাগিয়েছে তাদের কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। প্রশাসন যেন তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়।