এখনো শোকাহত কামরান পরিবার
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:১৮ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরু :
সিলেটে এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি কামরান পরিবার। শোক সইতে না সইতে আরেক মৃত্যু। আবারো শোক বিরাজ করছে ওই পরিবারে। যেন বিপর্যস্ত চারদিক। কান্নার রোলও থামেনি। প্রতিবেশীরা সকাল, বিকাল কান্নার আওয়াজ শোনেন ওই পরিবারের। সান্ত্বনার ভাষা নেই কারো কাছে। দিন যতই যাচ্ছে ততই পরিবারে শূন্যতা বাড়ছে।
এটি হচ্ছে সিলেটের কামরান পরিবার। সিলেটের মানুষ এক নামেই চিনেন ওই পরিবারকে। দরোজা সব সময় খোলা। গেলেই সান্ত্ব্তনা পাওয়া যাবে। ৩ মাসের অধিক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। প্রিয় সিলেটকে ছেড়ে চিরদিনের মতো পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন কামরান। শুয়ে আছেন সিলেটের হযরত মানিক পীর (র:) মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে। সিলেটের সাবেক মেয়র কামরান। ছিলেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা। একজন অভিভাবক হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। সিলেটের মানুষের সুখে, দুঃখে ছুটে যেতেন কামরান। বাসায় কেউ গেলে দিতেন সান্ত্ব্তনা। রমজানের ঈদের পর থেকে মহামারি করোনায় বিপর্যস্ত ছিল কামরানের পরিবার। প্রথমেই স্ত্রী আসমা কামরান করোনায় আক্রান্ত হন। এতে ভেঙে পড়েন কামরান। স্ত্রীর অসুস্থতায় বিষণ্নতা তাকে গ্রাস করে। স্ত্রী অসুস্থতার মধ্যেই ৫ই জুন করোনায় আক্রান্ত হন তিনি নিজেই। প্রথমে বাসায়, পরে সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর সিএমএইচ-এ। উন্নত চিকিৎসায়ও বাঁচানো গেল না সাবেক মেয়র কামরানকে। ১৫ই জুন তিনি সিলেটবাসীকে কাঁদিয়ে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। কামরানের মৃত্যুর পর পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পরিবার। পরিবারের অভিভাবক ছিলেন। পরিবার, রাজনীতি, মানুষের সেবা- সব এক হাতেই পরিচালনা করতেন। এ কারণে পরিবারের সবাই ছিলেন নির্ভার। যে যার মতো চলেছেন। হঠাৎ করে কামরানের মৃত্যুতে পুরো পরিবার ছন্নছাড়া হয়ে যায়। ভেঙে পড়েছেন স্ত্রী আসমা কামরান। তিনি নিজেও মহিলা লীগের নেত্রী। এরপরও স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি। সকাল হলেই অঝোরে কেঁদে ওঠেন। বিকালেও কাঁদেন। সব যে ‘আউলা’ হয়ে গেছে আসমা কামরানের। নিজের প্রতি খেয়াল নেই। করোনা ছিল তার। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি সুস্থ হয়েছেন। কিন্তু এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি। কামরান যেন তার আশপাশেই রয়েছেন। শুক্রবার জুমার নামাজের পর হঠাৎ মনে পড়ে কামরানের কথা। জীবিত থাকা অবস্থায় জুমার পর স্বামীকে নিয়ে খেতে বসতেন। কিন্তু এখন আর স্বামী নেই। ফলে তার সব স্বপ্ন যেন উবে গেছে। গতকাল দুপুরের খাওয়া শেষে ইউটিউবে কামরানের পুরাতন ভিডিও দেখেন। স্বামীর ভিডিও দেখে আবারো কান্না শুরু করেন। এভাবেই এখন কাটছে আসমা কামরানের সময়। বড় ছেলে ডা. আরমান আহমদ শিপলু এখন পরিবারের কর্তা। মা’কে নিয়েই তার সব দুশ্চিন্তা। এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি। প্রতিদিনই মানুষজন বাসায় আসেন। বাসায় এলেই মানুষ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন আসমা। কারো সঙ্গে কথা বলতে গেলেই অঝোরে কাঁদেন। কামরানের এক বছরের ছোটো ছিলেন ভাই বখতিয়ার আহমদ কানিজ। দুই ভাই ছিলেন পিঠে-পিঠি। এ কারণে তাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মিলও ছিলেন অনেক। সেই শৈশব কাল থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছেন। প্রবাসেও ছিলেন। অনেক স্মৃতি ছিল তাদের দুই ভাইয়ের। কিডনি রোগে ভুগছিলেন কানিজ। বড় ভাই কামরানের মৃত্যুর সময়ও ছিলেন তিনি অসুস্থ। এরপরও কামরানের অসুস্থায় তিনি আরো ভেঙে পড়েছিলেন। মৃত্যুর পর আরো বেশি বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এ কারণে কানিজও হয়ে পড়েন অসুস্থ। কিডনির অসুস্থতা আরো বেশি বাড়তে থাকে। চলতি মাসেই তিনিও ভর্তি হলেন হাসপাতালে। আর তিনি উঠতে পারেননি। ভাতিজা ডা. শিপলু তার চিকিৎসায় ত্রুটি রাখেননি। শেষমেশ তাকে রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলেন ৮ দিন। এরপর বড় ভাই কামরানের শোকে কাতর কানিজ চলে গেলেন পরপারে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে মারা গেলেন দুই ভাই। ফের শোকাহত হয়ে পড়েছে কামরান পরিবার। কাঁদছে সবাই। একের পর এক মৃত্যু গোটা পরিবারকে বিপর্যস্ত করে দিয়ে যাচ্ছে। কামরানের পরিবারে মানুষের যাতায়াত কমেনি। কামরানের জীবদ্দশায় অনেক মানুষ ছুটে যেতেন নানা কাজে। কিন্তু মৃত্যুর পরও মানুষের যাওয়া-আসা বন্ধ হয়নি। খোঁজ খবর নিতে যাচ্ছেন সবাই। কামরান নেই, গোটা পরিবারের এখন হাল ধরেছেন তারই বড় ছেলে ডা. আরমান আহমদ শিপলু। তিনিও বিপর্যস্ত। অনেক কাজ। কামরান ছিলেন কয়েকটি মসজিদ, মাদ্রাসার মোতাওয়াল্লি। এর বাইরে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তদারকি করতেন। জীবদ্দশায় তিনি অসহায় পরিবারের ছায়া হয়ে ছিলেন। নানা কাজে আসা মানুষদের সহায়তার পাশাপাশি পরামর্শও দিতেন। কামরানের মৃত্যুর পর সব দায়িত্ব এখন কাঁধে শিপলুর। তিনিও ধীরে ধীরে সব গোছাতে শুরু করেন। পিতার রেখে যাওয়া দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন। নিজের পরিবার সহ চাচা, ফুফু এবং আত্মীয়-স্বজনদের পরিবারের দেখভাল করছেন তিনি। কামরানের বড়পুত্র ডা. আরমান আহমদ শিপলু মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ‘বাসায় নানা কাজে এখনো মানুষ আসে। আব্বু নেই। তার প্রিয় ড্রয়িং রুমে বসি আমি। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে আসা মানুষদের সঙ্গ দেই। তাদের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করি।’ তিনি জানান- ‘রাজনীতির বাইরে ‘মানবিক কামরান’ ছিলেন সিলেটের মানুষের ভরসাস্থল। পিতার মৃত্যুতে সেই শূন্যতা পূরণ কোনো দিনই হবে না। তবে যতটুকু পারছেন তিনি সাধ্যমতো করার চেষ্টা করছেন। আপাতত মসজিদ, মাদ্রাসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বও নিচ্ছেন।’