সিলেট-তামাবিল সড়ক চারলেন : প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৬৪ কোটি টাকা
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১১:১৯ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
সিলেট শহর থেকে সড়কপথে তামাবিল স্থল শুল্কবন্দরের দূরত্ব ৫৬ কিলোমিটার। দুই লেনের এই সড়ককে চার লেনে উন্নীত করার জন্য একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পে যে খরচ ধরা হয়েছে, তা সমজাতীয় বেশ কয়েকটি চার লেন সড়কের তুলনায় অনেক বেশি।
কাগজপত্র ঘেঁটে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সিলেট থেকে তামাবিল পর্যন্ত চার লেনের সড়কটি নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ৬৪ কোটি টাকা, যা সমজাতীয় চার লেন সড়ক নির্মাণের খরচের তুলনায় দুই থেকে চার গুণ বেশি।
তিন হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ’ প্রকল্পটি গত ১ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে চীনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এশিয়ান অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (এআইআইবি) ঋণ দিচ্ছে দুই হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। বাকি ৬১৬ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জোগান দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, সিলেট থেকে তামাবিল পর্যন্ত বিদ্যমান দুই লেনের সড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে যে টাকা খরচ দেখানো হয়েছে, তা করা হয়েছে কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সাধারণত উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে কোনো চার লেন সড়ক প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হয় ১৮ থেকে ৩৪ কোটি টাকা। যদিও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চার লেনের একটি মহাসড়কে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হওয়ার কথা ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এ ধরনের সড়ক নির্মাণের খরচ যে বেশি, তা এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বুয়েটের গবেষণায় উঠে এসেছে। বিভিন্ন মহল থেকে ওঠা সমালোচনার পরও চার লেনের সড়কে কিলোমিটারপ্রতি খরচ কিছুতেই কমছে না। নানা অজুহাতে খরচ বাড়ানো হচ্ছে; যার সব শেষ উদাহরণ সিলেট থেকে তামাবিল মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি।
এর আগে ১৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার খরচ পড়েছে কিলোমিটারপ্রতি ২১ কোটি টাকা। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে কিলোমিটারে ২১ কোটি টাকা। যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর আট লেন প্রকল্পে খরচ হয়েছে ২২ কোটি টাকা। রংপুর থেকে হাটিকুমরুল চার লেনে খরচ পড়েছে ৫৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ঢাকা-সিলেট প্রস্তাবিত চার লেনের সড়কটির কিলোমিটারপ্রতি খরচ ধরা হয়েছে ৬০ কোটি টাকা।
চলমান করোনাভাইরাসের প্রভাবে আয় কমে যাওয়ায় সরকার যেখানে গাড়ি কেনা বন্ধসহ বিভিন্ন খাতে কৃচ্ছ অবলম্বন করছে, সেখানে উল্টো সিলেট-তামাবিল সড়ক চার লেনে উন্নীত করতে গাড়িবিলাস, পরামর্শকের পেছনে হাতি পোষার মতো খরচ এবং বেশি দামের কম্পিউটার কেনার আয়োজন চলছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে সরকার নতুন করে সব ধরনের যানবাহন কেনা বন্ধ রাখলেও এই প্রকল্পে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি জিপ কেনার তোড়জোড় চলছে। এর মধ্যে একটি গাড়ি ব্যবহার করবেন প্রকল্প পরিচালক, একটি ব্যবহার করবেন অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক, অন্যটি ব্যবহার করবেন প্রকল্পের ব্যবস্থাপক। প্রতিটি জিপ কেনা হবে ৯৮ লাখ টাকা করে।
তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রকল্প পরিচালক, অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক ও প্রকল্পের ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ের জন্য তিনটি কালার টিভি কেনা হবে; যার প্রতিটির খরচ দেখানো হয়েছে এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা। প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়সহ মোট সাতটি পানি পরিশোধক কেনা হবে, যার প্রতিটির খরচ দেখানো হয়েছে ১৫ হাজার টাকা করে। প্রকল্পের আওতায় ছয়টি পিকআপ কেনা হচ্ছে। এ জন্য সাড়ে তিন কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ছয়টি কম্পিউটার কেনা হবে; যার প্রতিটিতে খরচ ধরা হয়েছে এক লাখ ৩২ হাজার টাকা। ১৬টি ল্যাপটপ কিনতে প্রতিটিতে খরচ ধরা হয়েছে ৮৮ হাজার টাকা। আর পরামর্শকের পেছনে খরচ হবে ৬৭ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ওপারে ভারতের মেঘালয় থেকে পাথরসহ বিভিন্ন পণ্য তামাবিল বন্দর দিয়ে আনা-নেওয়া করায় সিলেট-তামাবিল সড়কটি ব্যবসায়ীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ভারত, ভুটান, মিয়ানমার ও চীনের উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রেও এই সড়ক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়ানোর পাশাপাশি যাত্রী ও মালপত্র দ্রুত পরিবহন করতে সরকার সিলেট-তামাবিল বিদ্যমান দুই লেনের সড়ক চার লেনে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই প্রকল্পে মোট তিন হাজার ৫৮৬ কোটি টাকার মধ্যে পরামর্শক ব্যয়, যানবাহন কেনা, সম্মানী, টেলিফোন, জ্বালানিসহ অন্যান্য খাতে ১০০ কোটি টাকা খরচ হবে। এই ১০০ কোটি টাকা বাদ দিয়ে তিন হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা খরচ হবে চার লেনের সড়ক নির্মাণে।
তথ্য বলছে, সিলেট-তামাবিল দুই লেনের সড়কটি ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক কিংবা কক্সবাজারের মাতারবাড়ীর খাসিয়াখালী পেট্রল পাম্প থেকে ধলঘাট মোড় পর্যন্ত সড়কের মতো নিচু জমিতে নয়। সড়কটি অনেকটা উঁচু।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ৯৩৯ মিটারের তিনটি সেতু নির্মিত হবে, যাতে খরচ হবে ৪৮৭ কোটি টাকা। ৫৬ কিলোমিটার পেভমেন্ট নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ২৯৮ কোটি টাকা। আর্থওয়ার্ক নির্মাণে খরচ হবে ৪১৭ কোটি টাকা। ৬২৫ মিটার কালভার্ট নির্মাণে খরচ হবে ৬৩ কোটি টাকা। যাত্রীদের জন্য শেড নির্মাণে খরচ হবে ১১৬ কোটি টাকা। ভূমি অধিগ্রহণে খরচ হবে ৭৬৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া টোল প্লাজা নির্মাণ ও এক্সেল লোড স্টেশন নির্মাণে খরচ হবে ২০ কোটি টাকা। জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, সড়ক ও সেতুসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে মোট খরচ হবে তিন হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি খরচ হচ্ছে ৬২ কোটি টাকা। আর মোট খরচ হিসাব করলে কিলোমিটারপ্রতি ৬৪ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বলছে, চার লেনের একটি সড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হওয়ার কথা ১২-১৫ কোটি টাকা। পাশের দেশ ভারতে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হয় ১০ কোটি টাকা। চীনে হয় ১০-১২ কোটি টাকা। ইউরোপে ৩০ কোটি টাকা।
বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে প্রতিবেশী ভারত ও চীনের তুলনায় অনেক বেশি অর্থ খরচ হয়। এই বাড়তি খরচের জন্য উচ্চ মাত্রায় দুর্নীতি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হওয়া ও দরপত্রে প্রতিযোগিতা না থাকাকে দায়ী করেছে বিশ্বব্যাংক।
বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, সিলেট-তামাবিল সড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে কিলোমিটারপ্রতি ৬৪ কোটি টাকা খরচ অস্বাভাবিক। কারণ সেখানে তো বিদ্যমান দুই লেনের সড়ক আছেই। এই প্রকল্পের জন্য এআইআই ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে। তারা এমন কিছু শর্ত দেয়, যা দেশের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি বলেন, চুক্তি করতে হবে দেশের জনগণের স্বার্থে। এই প্রকল্পে অর্থের অপব্যবহার হচ্ছে কি না তা সরকারকে খতিয়ে দেখার অনুরোধ করেন তিনি।
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, এত চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কেন এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে, যেখানে এর চেয়ে কম সুদে ঋণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। অথবা এ ধরনের প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নেও করা সম্ভব।
জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী এবং এই প্রকল্প তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘সিলেট-তামাবিল চার লেনের সড়কটি নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ৬৪ কোটি টাকা খরচের যে কথা বলা হচ্ছে, আসলে এত টাকা খরচ হবে না। আমাদের হিসাব বলছে কিলোমিটারপ্রতি ৩৭ কোটি টাকা খরচ হবে।’ কিন্তু বর্তমান হিসাবেও অন্য সড়কের সঙ্গে তুলনা করলে কিলোমিটারপ্রতি ৩৭ কোটি টাকা খরচ কি বেশি নয়—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্পের আওতায় চার লেনের বাইরেও সাড়ে পাঁচ ফুট পৃথক সার্ভিস লেন নির্মাণ করা হবে। সে জন্য খরচ কিছুটা বেশি হচ্ছে।’
গাড়ি কেনাসহ অন্য আরো কিছু কেনাকাটা বাদ দেওয়া হতে পারে বলে জানান ফয়েজ আহমেদ। সমীক্ষার বিষয়ে তিনি বলছেন, বিদেশি পরামর্শকই সমীক্ষা করেছে। তারাই এ প্রকল্পের খাতওয়ারি খরচগুলো নির্ধারণ করে দিয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা বলছেন, চীনের এআইআই ব্যাংকের ঋণের সুদের হার সাড়ে ৩ শতাংশ। পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২৫ বছরের মধ্যে এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। ঋণের এই সুদের হার বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এডিবিসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর তুলনায় বেশি। তাদের সুদের হার ২ শতাংশ।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সড়কের একটি প্রকল্পে কেন টেলিভিশনের প্রয়োজন হলো? রাস্তার প্রকল্পে টেলিভিশন কী কাজে লাগবে? তা ছাড়া একটি টেলিভিশনের দাম এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা অবশ্যই অতি মূল্যায়িত খরচ ধরা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক অফিসে বসে কি নেটফ্লিক্স দেখবেন? তাঁর কাজ কি টেলিভিশন দেখা?’
প্রকল্পে এত অস্বাভাবিক ব্যয় কিভাবে পরিকল্পনা কমিশনের হাত দিয়ে অনুমোদন দেওয়া হয় তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ড. জাহিদ হোসেন। এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘কিলোমিটারপ্রতি ৬৪ কোটি টাকা খরচের হিসাব তো পরিকল্পনা কমিশন থেকে জানতে চাওয়া উচিত ছিল। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পাওয়ার মানে হলো পরিকল্পনা কমিশন তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। এখানে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কমিশনের সমঝোতার বিষয়টি স্পষ্ট।’