সিলেটে কমিটি নিয়ে ‘হাওয়া গরম’ আওয়ামী লীগে
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:০৭ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরু :
কেন্দ্রের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা জমা দেয়া হয়েছে। প্রথমে কমিটি জমা দেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন খান। এরপর জমা দেন মহানগর সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ ও জাকির হোসেন। এখন পূর্ণাঙ্গ দু’টি কমিটি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছেন সিলেটের নেতারা। কিন্তু এরই মধ্যে হাওয়ায় ভেসে আসছে নানা খবর। ক্ষোভ বাড়ছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে। এই অবস্থায় ঢাকায় ছুটতে শুরু করেছেন সিলেটের নেতারা। আসন্ন দু’টি পূর্ণাঙ্গ কমিটির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগও দাখিল করা হচ্ছে।
এতে করে সিলেট আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরের পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হতে শুরু করেছে। এমনিতেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দিয়ে দু’টি কমিটি ৯ মাস পূর্ণ করেছে। তার উপর এখন নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন না করা, পছন্দের কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া, ত্যাগী নেতাদের বাদ দেয়ার মতো ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এ কারণে আগে থেকেই সোচ্চার হতে শুরু করেছেন সিলেটের ত্যাগী নেতারা। সিলেট আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন কখনোই সুখকর ছিল না। যখনই কমিটি গঠন করা হয়েছে তখনই দেখা দিয়েছে বিরোধ, হয়েছে বিক্ষোভও। ২০১১ সালে সর্বশেষ সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। তখন সিলেট আওয়ামী লীগের দায়িত্বে ছিলেন জাঁদরেল রাজনীতিকরা। ওই সময়ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর কমিটি বর্জন, ঝাড়ু মিছিল, পাল্টা কমিটি গঠনের হুমকি ছিল। জেলার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার হোসেন শামীমের পক্ষে উপজেলা পর্যায়ের নেতারা একজোট হয়েও কাজ হয়নি। তবে- সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এবং প্রায় ৮ বছর ওই কমিটি দায়িত্ব পালন করে। এবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিই সিলেটে নতুন ফরম্যাট করে দিয়েছে। সিলেট আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। তাদের হাত ধরেই নবযাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে সিলেট আওয়ামী লীগ। গত ৫ই ডিসেম্বরের সম্মেলনের পর সেই পথে হাঁটছে সিলেট আওয়ামী লীগ। এরপর প্রভাব এবার পড়তে যাচ্ছে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে। কিন্তু এতে অবমূল্যায়নের অভিযোগ তুলেছেন আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র ও ত্যাগী নেতা। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- দু’টি পদের দুই সিনিয়র সহ সভাপতি পদ নিয়ে। সিনিয়র নেতারা এ দুই পদের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী ও সিলেট-৩ আসনের এমপি মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা জানান- এই পদে কে আসবেন সেটি সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্র। ফলে এ পদ নিয়ে প্রেস্টিজ ইস্যুতে নেমেছেন শফিক ও সামাদ। দু’জনই কেন্দ্রে লবিং চালাচ্ছেন বলে সিলেটের নেতারা জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্য থেকে ইতিমধ্যে দেশে ফিরেছেন শফিকুর রহমান চৌধুরী। জেলার মতো মহানগরেও অবস্থাও একই। মহানগরের সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে প্রস্তাব করা হয়েছে সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদের নাম। আসাদ উদ্দিন আহমদ এ পদে যোগ্য নেতা হলেও তার আপন বড় ভাই মাসুক উদ্দিন আহমদ মহানগর সভাপতি। ফলে এক ঘরে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি পদ চলে যাওয়াকে মেনে নিচ্ছেন না অনেকেই। মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ফয়জুল আনোয়ার আলাউর জানিয়েছেন- যে কমিটি প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানেই অনেকেই অবমূল্যায়িত হয়েছেন। এ কারণে সংক্ষুব্ধ হয়েছেন অনেকেই। অনেকেই এখন কেন্দ্রের কাছে তাদের মতামত জানাচ্ছেন। এদিকে- ঢাকায় অবস্থান করা সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন- মহানগর কমিটির সহ-সভাপতি, যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদগুলোতে সিনিয়র-জুনিয়র মানা হয়নি। সহ-সভাপতির বিচারে এডভোকেট মফুর আলী, রাজ উদ্দিন অনেক সিনিয়র। এছাড়া- যুগ্ম সম্পাদক পদে আব্দুর রহমান জামিল, এটিএম হাসান জেবুল সহ আরো এক সাবেক জনপ্রতিনিধির নাম রয়েছে। যুবলীগের সাবেক কাণ্ডারী ও সিটি কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদকেও যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি প্রস্তাবিত কমিটিতে। এছাড়া সাবেক কমিটির অন্তত ২০ জন নেতাকে বর্তমান কমিটি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এ কারণে বাদ পড়া নেতারা গতকাল কেন্দ্রের কাছে এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তারা বর্তমান কমিটিতে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন দাবি করেছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকায় অবস্থান করা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক কমিটির এক সিনিয়র নেতা। মহানগরের মতো জেলাতেও একই অভিযোগ। জেলায় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দিয়ে কমিটি গঠনের অভিযোগ করেছেন নেতারা। তবে- জেলাতে বাদ পড়েছেন কম। জেলায় সিনিয়র নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। আবার ছাত্রলীগ থেকে আসা অনেককে গুরুত্বপূর্ণ পদে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে করে প্রস্তাবিত কমিটি অনেকটা ভারসাম্য হারিয়েছে বলে দাবি করেছেন নেতারা। জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। তারা কেন্দ্রের কাছে প্রস্তাবিত কমিটি নিয়ে তাদের অভিযোগও দিয়েছেন। জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক পদে হুমায়ূন ইসলাম কামাল, মোহাম্মদ আলী দুলাল ও কবির উদ্দিন আহমদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু এই তিন নেতাই সাংগঠনিক ভাবে শক্তিশালী নয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে হেরেছেন। তাদের ভূমিকার কারণে জামায়াতের কাছে হেরেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। আবার সাংগঠনিক সম্পাদক থাকাকালে ইউনিয়ন কমিটি গঠনে টাকার খেলার অভিযোগ আছে কারো কারো বিরুদ্ধে। কেউ আবার অন্যের পরিচিতি বহন করে নিজেকে বড় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্রস্তাবিত কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে এডভোকেট মাহফুজ, সাইফুল ইসলাম রুহেল ও এডভোকেট রণজিৎ সরকারের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এখানেও যথাযথ মূল্যায়নের অভিযোগ আছে। এছাড়া হত্যা মামলার আসামিরাও এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই তিনজনের মধ্যে দুইজন ইতিমধ্যে কেন্দ্রের কাছে নালিশ করেছেন বলে জানিয়েছেন জেলার এক নেতা। জগলু চৌধুরী হচ্ছেন সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। এবারের সম্মেলনে উপ দপ্তর সম্পাদক পদ থেকে তিনিও ছিলেন সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী। কিন্তু ভাগ্য বিড়ম্বনায় পড়তে যাচ্ছেন জগলু চৌধুরী। উপ শব্দটি বাদ যাচ্ছে তার। এখানে অবমূল্যায়নের অভিযোগ তুলছেন জগলু চৌধুরী নিজেই। আওয়ামী লীগের বিগত কমিটিতে সাংগঠনিক দক্ষতা দেখালেও তিনি একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছেন। তার সঙ্গে মজির উদ্দিন নামের অখ্যাত এক নেতার নাম উপ দপ্তর হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। মজির উদ্দিন মূলত বালু, পাথর ব্যবসায়ী। কোরবানির হাটের ইজারাদারও তিনি। ফলে মজির উদ্দিনের বিষয়টি ইতিমধ্যে কেন্দ্রের কাছে কয়েক জন নেতা অভিযোগ করে জানিয়েছেন। এডভোকেট আজমল আলী, মোস্তাক আহমদ পলাশ দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন প্রস্তাবিত কমিটিতে। তাদের বিরুদ্ধে খোদ দলীয় নেতাদের বিস্তর অভিযোগ। ঢাকায় অবস্থানরত এক নেতা জানিয়েছেন- তারা বালু ও পাথর ব্যবসায় বিতর্কিত। পাশাপাশি হত্যা মামলারও আসামি হয়েছেন কেউ কেউ। ফলে তাদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করলে বিতর্ক পিছু ছাড়বে না। প্রচার সম্পাদক হিসেবে প্রস্তাবিত হয়েছেন ছাত্রলীগ থেকে আসা নেতা এডভোকেট আব্বাস উদ্দিন। তার সঙ্গে উপ প্রচারে মতিউর রহমান মতি নামে অখ্যাত এক নেতার নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনির পরিবারের সদস্য বলে নেতারা তাকে কেউ কেউ অভিহিত করছেন। জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি থেকে এবার বাদ পড়ছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ, এডভোকেট শেখ মখলু, এডভোকেট ময়নুল হক, অধ্যক্ষ শামসুল হক সহ কয়েকজন নেতা।