সিলেটে প্রেমের ফাঁদ: আক্রান্ত ৪১৩, ধর্ষিত ৩৪০
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ৪:১১ অপরাহ্ণ
তুহিনুল হক তুহিন:
প্রেম বা বিয়ে। দুটো সম্পর্কের সাথেই জড়িয়ে বিশ্বাস ও ভরসা। সেই বিশ্বাস আর ভরসার জায়গাটি ভুল হওয়ায় সিলেটে প্রেম কিংবা বিয়ের প্রলোভনে বেড়েছে ধর্ষণ। বেশির ভাগ এসব ঘটনার শিকার হচ্ছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণীরা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘরের বধূরাও এমন ঘটনার শিকার হচ্ছেন পরকীয়া প্রেমিকের পাল্লায় পড়ে। এসব ঘটনায় সকল ক্ষেত্রে থানায় মামলা হয় না লোকলজ্জার ভয়ে। আর থানায় মামলা হলেও তেমন কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। পরিসংখ্যান বলছে, এমন ঘটনা দিনদিনই বেড়ে চলেছে। সিলেট বিভাগে গত ৮ মাসে ৩৪০ জন ধর্ষণের শিকার হয়ে ওসিসিতে চিকিৎসা নেন। সেই সাথে যৌন হয়রানি কিংবা নানাভাবে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেন ৪১৩ জন কিশোরী-তরুণী ও গৃহবধূ।
ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটেছে সিলেটে। গত বছরের তুলনায় এবছর সিলেট বিভাগে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর ছিল যৌতুক কিংবা স্বামী-স্ত্রী পারিবারিক বিরোধে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। এছাড়া গৃহবধূর সাথে পরকীয়ার সম্পর্কের জেরে ধর্ষণের মত ঘটনা। সেই সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে অনেক তরুণীরা ধর্ষণের শিকার হন। জানুয়ারি মাসে সিলেট ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি)’তে আক্রান্ত ভিকটিমের সংখ্যা ছিল ৬১জন। এরমধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কিশোরী-তরুণী-গৃহবধূসহ ৫০জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ওসিসিতে চিকিৎসা নেন ৬৮জন ভিকটিম, এরমধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫০জন। মার্চ মাসে ওসিসিতে চিকিৎসা নেন ৬৭জন ভিকটিম, এরমধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫২জন। এপ্রিল মাসে ওসিসিতে চিকিৎসা নেন ২৪জন, এরমধ্যে ধর্ষণের শিকার হন ২৩জন। মে মাসে ওসিসিতে চিকিৎসা নেন ২৮জন ভিকটিম, এরমধ্যে ধর্ষণের শিকার হন ২৬জন। জুন মাসে ওসিসিতে চিকিৎসা নেন ৪৫জন ভিকটিম, এরমধ্যে ধর্ষণের শিকার হন ৩৭জন। জুলাই মাসে ওসিসিতে চিকিৎসা নেন ৪৫জন ভিকটিম, এরমধ্যে ধর্ষণের শিকার হন ৪৩ জন। আগস্ট মাসে ওসিসিতে চিকিৎসা নেন ৫৮জন ভিকটিম, এরমধ্যে ধর্ষণের শিকার হন ৪৮জন। সেপ্টেম্বর মাসে (৭ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ওসিসিতে চিকিৎসা নেন ১৭জন ভিকটিম, এরমধ্যে ধর্ষণের শিকার হন ১১জন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন ওসিসি’র আইন বিষয় কর্মকর্তা পান্না সমাদাস। তিনি জানান, ২০১৯ সালে সিলেটে ধর্ষণের ঘটনা অনেকটা কম ছিল। তবে ওই বছর যৌতুকের জন্য নির্যাতন ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহের ঘটনায় আক্রান্তে ঘটনা ছিল। তবে এ বছর সিলেট বিভাগে বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনা। বেশির ভাগই ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে প্রেম সংক্রান্তে। এসব ঘটনায় আক্রান্ত বেশি হচ্ছে স্কুল-কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় তরুণীরা। মাঝে মধ্যে পরকিয়ার জেরে বিয়ের আশ^াসে প্রতারিত হয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন অনেক গৃহবধূ। তিনি বলেন, স্কুল-কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় পড়–য়া মেয়েরা কোথায় যাচ্ছে কি করছে সেসব বিষয়ে অভিভাবকদেরকে সর্তক থাকতে হবে। এছাড়াও এসব ঘটনা সামাজিকভাবে প্রতিহত করার ব্যাপারে আরও সোচ্চার হতে হবে। সচেতনতাই একমাত্র এসব ঘটনা থেকে মুক্তি দিতে পারে।
পুলিশ সূত্র জানায়, বিয়ের প্রলোভন দিয়ে ৬ মাস ধরে এক বিধবাকে ধর্ষণের অভিযোগে আবদুল্লাহ মিয়া (৩৫) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে গোয়ানইঘাট থানা পুলিশ। তিনি উপজেলার পশ্চিম আলীরগাঁও ইউনিয়নের পুকাশ প্রামের মো. আবদুর রবের ছেলে। গত ৪ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকায় সালিশ বৈঠক বসে। সালিশে উভয় শারীরিক সম্পর্কের কথা স্বীকার করলে ওই নারীকে বিয়ে করতে বলা হয় আবদুল্লাহ মিয়াকে। কিন্তু তাতে রাজি হননি আবদুল্লাহ। এরপর ওই নারী থানায় মামলা দায়ের করেন। অপরদিকে, মৌলভীবাজারে বাসায় গাঁজা পার্টির আয়োজন করে তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে মৌলভীবাজার মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। ভুক্তভোগী ওই তরুণী বাদী হয়ে গত সোমবার (৩১ আগস্ট) থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। পরে মডেল থানা পুলিশ তা মামলা হিসেবে আমলে নেয়। মামলায় এজাহারে ছাত্রফ্রন্ট মৌলভীবাজার জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক (বহিষ্কৃত) সজীব তুষারকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। এছাড়া জেলা বাসদের সদস্য রায়হান আনসারী ও নারী সুরক্ষা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মারজিয়া প্রভাকে ধর্ষণের সহযোগী উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে। গত ৩ আগস্ট রাতে মৌলভীবাজার শহরের সোনাপুর এলাকার মাহমুদ এইচ খান নামে এক তরুণের বাসায় ধর্ষণের ওই ঘটনা ঘটে। ওই দিন ওই বাসায় গাঁজা পার্টি দেওয়া হয়। এই পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন পাঁচ জন তরুণ-তরুণী। সেখানে সজীব তুষার এক তরুণীকে ধর্ষণ করেন। বিষয়টি চাপা থাকলেও প্রায় ২০ দিন পর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাহমুদ এইচ খান পোস্ট দিলে বিষয়টি প্রকাশ পায়। মাহমুদ এইচ খানের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে জানা যায়, মাহমুদ এইচ খানের মৌলভীবাজারের বাসায় গত ৩ আগস্ট ডিনার পার্টির আয়োজন করা হয়। পার্টিতে উপস্থিত হন ছাত্রফ্রন্ট মৌলভীবাজার জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক (বহিষ্কৃত) সজীব তুষার, বাসদ কর্মী (বাসদ মৌলভীবাজার জেলা বর্ধিত ফোরামের বহিষ্কৃত সদস্য) আয়কর আইনজীবী রায়হান আনসারী, নারী সুরক্ষা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মার্জিয়া প্রভা এবং ধর্ষণের শিকার ওই তরুণী। মাহমুদ এইচ খান ওই স্ট্যাটাসে অভিযোগ করেন, বাসায় আড্ডার ফাঁকে তুষার গাঁজা বের করে সবাইকে নিয়ে সেবন করেন। ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে বেশি গাঁজা খাওয়ান তিনি। গাঁজা খাওয়ানো নিয়ে মাহমুদ এইচ খান প্রতিবাদ করলেও মার্জিয়া প্রভা ও রায়হান আনসারী মাহমুদকে থামিয়ে দিয়ে মেয়েটিকে গাঁজা খেতে প্ররোচিত করেন। একটা পর্যায়ে মেয়েটি অসুস্থ হয়ে ঘুমানোর ইচ্ছে প্রকাশ করলে তুষার তাকে রুম ও বিছনা দেখিয়ে দেওয়ার কথা বলে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন। তবে ধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সজিব তুষার। মামলার বাদী ধর্ষণের শিকার ওই তরুণী গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘আমি প্রথমে পরিবারের মান-সম্মান ও সামাজিক অবস্থান চিন্তা করে মামলা করিনি। আমার পরিবারকে জানানোর পর তারাও মামলায় সম্মতি দেয়নি। পরে যখন দেখলাম আমাকে উল্টো দোষ দেওয়া হচ্ছে এবং একটি ধর্ষণের ঘটনাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, তখন আমার কাছে বেশি আঘাত লাগে। তখন পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আমি মামলা করি। সত্য জানানোর জন্য মামলা দেওয়া তখন জরুরি ছিল। আশা করছি, সঠিক বিচার পাবো এবং আসল সত্য বের হয়ে আসবে।
এছাড়া সিলেটে এক কিশোরীকে (১৪) অপহরণ করে এক নারীর বাসায় ১৭ দিন আটকে রেখে ধর্ষণের ঘটনায় ওই নারীসহ ধর্ষককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অভিযুক্ত ধর্ষকের নাম সাদিকুর রহমান (২২)। ৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে গ্রেপ্তারকৃতদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। এর আগে ৩ সেপ্টেম্বর সকাল জালালাবাদ থানা পুলিশের একটি দল শহরতলীর মইয়াচর থেকে সাদিকুর রহমান ও সহায়তাকারী নারীকে গ্রেপ্তার করে। আর উদ্ধারকৃত কিশোরীকে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করা হয়। ওই কিশোরী পুলিশকে জানায়, সাদিকুর রহমান তাকে অপহরণ করে একটি বাসায় আটকে রেখে ১৬ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময় ধর্ষণ করে। অপরদিকে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার লালাবাজারে এক কিশোরীকে (১৬) ধর্ষণ এবং ভিডিও ও ছবি ধারণের দায়ে কান্দিগাঁও ইউপির ৪ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য শাবাজ আহমদকে (৩৮) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় জালালাবাদ থানা পুলিশ ঘোপাল এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় কিশোরীর মা বাদী হয়ে জালালাবাদ থানায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করেন। অভিযোগ পাওয়া গেছে ইউপি সদস্য শাবাজ আহমদ ও তার আরও দুই সহযোগী গত ২ সেপ্টেম্বর বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে জালালাবাদ থানাধীন টুকেরবাজারস্থ পীরপুর জামে মসজিদের সামনে থেকে ওই কিশোরীকে অপহরণ করে দক্ষিণ সুরমা থানাধীন লালাবাজারস্থ এক বাসায় নিয়ে যায়। ওইদিন রাত ৯টার দিকে শাবাজ আহমদ ভিকটিমকে ধর্ষণ করার পর তার সঙ্গে থাকা অজ্ঞাতনামা আসামি ভিকটিমকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এসময় শাবাজ মোবাইল ফোনে সেই ভিডিও ও ছবি ধারণ করে। সূত্র- একাত্তরের কথা।