কাঁঠালচাঁপার আর্তনাদে হারিয়ে যাওয়া প্রহর : ২০তম খণ্ড
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ৯:৪১ অপরাহ্ণ
জাকির মোহাম্মদ:
কাজল আর ফেরদৌসির সময় অতিবাহিত হচ্ছিল মানসিক নানা টানাপোড়নের মধ্যে। কেন এমনটি হচ্ছে তার হিসেব কষলে দেখা যেতো,ফেরদৌসির বিয়ের ঘনঘন আলাপ একটি বিষয় হতে পারে। আজ যেমন দেখতে আসছে একজন ব্যাংকার। ফেরদৌসির বাবার বন্ধুর ছেলে। ইসলামী ব্যাংকে চাকরী করে। ভালো মাইনে পায়। বাবার রীতিমতো পছন্দের পাত্র। বাড়ির অন্যান্যদের পছন্দ কেমন কাজল তা বুঝতে পারেনি ফেরদৌসির কথার ফাঁকে। তবে,ভাইয়ের পছন্দ হলেও ছোট বোনেরা যারা কাজল সম্পর্কে ছিঁটাফুঁটা জানে তারা নাখোশ এই সংবাদে। আজ সকাল থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়েছে। স্থানীয় ডিউটি অফিসে কাজ শেষ করে ফেরদৌসিকে তাড়াতাড়া আসার ব্যাপারে আন্টি বারবার ফোন দিচ্ছেন। ফোনের রিংটোন বাজলেই কেন জানি ফেরদৌসিকে বিরক্তিকর একটি ভাব নিতে দেখছেন সাথে থাকা অফিসের কলিগ সুবর্ণা।
তোর কি হয়েছে?
আর কি জানোতো,আজই আব্বার দেখা পাত্র আসছে আমাকে দেখতে?
তো কি হয়েছে?
দেখাত আসলেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না পাগলী। যাও বাড়িতে। সবাই অপেক্ষা করছেন।
এই আপনিও তাদের সাথে সুর মেলালেন আপা?
আসলে আমাকে বুঝার কেউ নেই,কিছুই নেই আমার।
না,বুঝতে তোমাকে একটুও কষ্ট হয়না পাগলী। পরিবারের বড় সন্তান হলে মা বাবার চিন্তা একটু বেশি থাকে। তুমি বুঝবে না। আর তোমার তো সময় যাচ্ছে। তোমার পরে ভাই বোন আরও আছে। সেটি মাথায় ঢুকাও দেখবে সব ক্লিয়ার হয়ে গেছে।
আপা, সব ঢুকিয়ে কাজলকে বের করতে পারি না। এই ঔষধ কি আমাকে দেবেন?
কেন?
আজ কথা হয়নি তোমাদের?
তিন দিন হলো আপা,কাজলের সাথে কোন কথা নেই। পারিবারিক কী এক ঝামেলায় আছে? ব্যাস্ত। ফোন দিলে কেটে দিচ্ছে? আবার ব্যাকও করছে না। শুভ্রের কাছে ফোন দিয়েছিলাম,সে জানালো আজও বাসায় আসেনি।
কোন দুশ্চিন্তা নয় বোন,যাও বাড়িতে যাও। সবাই অপেক্ষা করছে।
ফেরদৌসি তার কালো ব্যাগটিকে গুছিয়ে কিছু জ্বরের আর ব্যাথার ঔষধ নিয়ে অফিস থেকে বেরোল। মাথার উপর সুর্য বেশ প্রকট। গরমে রীতিমতো হাঁপাচ্ছে সে। রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়েই মনে পড়ে গেল এখান থেকেই গতবার দুটি গাড়ি করে শুভ্র আর কাজল শহরে গিয়েছিল। তারপর আমরা একসাথেই গিয়েছিলাম দুলিয়ারবন্ধ। উঁচুনিচু চা বাগান,আর রাস্তার মোড়ের কারুকাজ এত সুন্দর ছিল,কাজল ফাঁকা রাস্তা পেয়ে শুয়েই গিয়েছিল একটি মোড়ে। শুভ্র কিছুক্ষণ ছবি তুলেছিল। শুভ্রের জন্য সেদিনও আমিও কাজলের গাঁঘেষে শুয়ে সামনে পিটিপিটি চোখ দিয়ে তাকাই। ভর রাস্তায় আমাদের ছবি তুলা দেখে পেছনে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। দুলিয়ারবন্ধ এলাকার কেউ পরিচিত ছিলো না বলে রক্ষে। নাইলে সেদিনের এসব পাগলামি সত্যিই অদ্ভুদ ছিল।
আনমনে হেসে ওঠে ফেরদৌসি। লেগুনা এসে হর্ণ দিলেই আনমনা ভাব ভেঙ্গে যায় তার। সিটে বসে। লেগুনার ভেতরে মাত্র তিনজন মানুষ। ভর দুপুরে অবশ্য মানুষ থাকারও কথা নয়। এমন সময় গরম থেকে বাঁচতে মানুষ ঘর থেকে বের হয় কম। একজন মহিলা হাতের পুটলিটা এমন ভাবে ধরে আছেন যেন সেখানে হীরা জহরত কিছু আছে। হয়ত যে কেউ টান মেরে নিয়ে যাবে,এই না নিয়ে যাবার হাত থেকে বাঁচাতে তিনি পুটলিটা ধরে আছেন শক্ত করে। আরেকজন কিশোর বয়সের। এক নাগাড়ে মোবাইলে কথা বলে যাচ্ছে। সে ছাড়াও লেগুনাতে আরও তিনজন মানুষ আছে সেটি যেন তার একেবারেই অজানা। বাবু খাইছো? এইসবটাইপ কথাবার্তা চলছে তো চলছে। হেসে হেসে পুটলিওয়ালির উপর যেন পড়ে। তিনি দিলেন স্বজোরে এক ধাক্কা। তারপর ছেলেটির হুশ ফিরে এলো,সে বললো স্যরি!
দক্ষিন বাজারে এসে লেগুনার কলকব্জা নষ্ট হয়ে গেল। এখানেই নামতে হবে।
নেমে ভাড়া দিতে গেলাম। ড্রাইভা র ততক্ষণে গ্যারেজে নেবার জন্য তাড়া দিচ্ছে হ্যাল্পারকে। চলে যান ম্যাডাম ভাড়া লাগবে না।
রিক্সা ডেকে ফেরদৌসি আবার বাড়ির পথে চললো। এবার হয়েছে মহা যন্ত্রণা। যতটুকু যায়,তারপরই আবার রিক্সা থামে। হয়েছে কি?
আফা,চেইন পড়ে যায় কিছু পরে পরে। সকালেও রিক্সা ঠিক করে বের হইছি। আমার কপাল খারাপ,আজ সারাদিন এরকম যাবে।
আমি কি অন্য রিক্সা দেখবো?
না, না আফা,লাগবে না। আরেকটুই তো জাগা। আমিই নিয়া যামুনে।
রিক্সার চেইন পড়ার এই মহাবিরক্তের রিক্সাচড়া শেষে যখন বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালো তখন বরপক্ষের লোকজন এসে হাজির। বাড়ির রাস্তায় গাড়ি দেখেই সেটি বুঝা গেল।
ফেরদৌসি আর সদর দরজা ধরে হাঁটা দিতে পারলো না। সে হালট পাড়ি দিয়ে সেজো চাচার ঘরে গিয়ে দাঁড়ালো। সেখান থেকে আন্টির ঘরে। এখানে অফিসের কাপড়খসা শেষ করে সে গেল মায়ের কাছে রান্না ঘরে। পেছনের দরোজায় দাঁড়ানো ফেরদৌসিকে দেখে মায়ের জান যেন ঘরে ফিরলো। আইছোনি গ মাই। বড় ফেরেশান লাগের? তোর রুমে যা। ফ্যানের নিচে। ডাকরাম পরে। তারা আইচ্ছে। নান্তাপানি হোক।
জয়নাবের পাশ দিয়ে যাবার সময় মাথায় টুকর মেরে গেল। যার অর্থ দাঁড়ায় এদিকে আয়। জয়নাব সেটি বুঝলো কি না সেটি বুঝেনি ফেরদৌসি। স্বপ্না দৌড় মেরে তার পিছু নিলো।
আইলায় গো শেষ পর্যন্ত?
আইতাম না কবে কইলাম।
ভাবতো এরকমই আসবে না। ফোন ধরো না,ব্যাক করো না। কী হয়েছে বলবি। ধুর কিছু না। যা কাজ কর গিয়ে। মাথাটা ঠান্ডা হোক আগে। আর ফ্রিজ থেকে এক গ্লাস পানি দিয়ে যা।
ওরে বাবাহ। দেখো তাইস?
যা কইলাম যা।
আচ্ছা।
ধুমছে নাস্তাপানি হচ্ছে। মানুষ এসেছেন পাঁচজন। কিন্তু খাবার আর পরিবেশনা এবং খালি প্লেট আসাতে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না,কত হিংস্র ক্ষুধার্ত বরপক্ষ। অথবা এও হতে পারে এত খরচ করে কনে দেখতে এসেছি,উশল করে যাই। হাহাহা। হেসেই ফেলে একেবারে। স্বপ্না দৌড় দেয়। তোর কি হয়েছে। পাগলের মত হাসিস কী?
পাগল হতে বাকি কি?
এই পাগলরা যেভাবে খাচ্ছে কিছুক্ষণ পর দুপুরের খাবার খাবে সেটি যেন মনেই নেই। বলে রাখলাম আম্মারে বল,ভাত এক ডেকছি বেশি রান্না করার জন্য। এবার শব্দ করে হাসে স্বপ্নাও। দুজনের এই অনাকাঙ্ক্ষিত হাসি তামাশা কতক্ষণ চলতো কে জানে। এরই ফাঁকে তাদের মাঝে এসে উপস্থিত হন আন্টি। হাতে হাফ সিল্কের কাতান শাড়ি। মেচ করা ব্লাউজ,ওড়না,জুতা,লিপস্টিক। ড্রেসিংটেবিলে এতসব আয়োজনের সাথে মাল্টিকালার ক্রিম দেখে নাক ছিটকায় ফেরদৌসি। না আন্টি। এই ক্রিম আমি দেবো না। এতে যদি তোমাদের বর পক্ষ খুশি না হয় আমার করার কিছু নেই। কথা বলার ঢঙ্গে সবাই হেসে ওঠে। ফেরদৌসি দেখে আম্মা দরোজায় দাঁড়িয়ে…
চলবে…