প্রাণ ফিরেছে যুক্তরাজ্যের কারিশিল্পে
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:১৭ পূর্বাহ্ণ
কাফি কামাল, যুক্তরাজ্য থেকে:
বাইরে ভোজনরসিকদের দীর্ঘ লাইন, ভেতরে রেস্টুরেন্ট কর্মীদের দারুণ ব্যস্ততা। আগস্টজুড়ে সোম থেকে বুধবার যুক্তরাজ্যে রেস্টুরেন্টগুলোর বাইরে দেখা গেছে এমন চিত্র। সরকার ঘোষিত ‘ইট আউট টু হেল্প আউট’ স্কিমের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে ভোজনরসিকরা। সোমবার ছিল এই স্কিমের শেষদিন। রসনা বিলাসীদের ভিড়ও ছিল উপচেপড়া। তবে কিছু খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান নিজেরা ভর্তুকি দিয়ে সেপ্টেম্বরজুড়ে স্কিমটি চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কোভিট-১৯ পেনডেমিকের কারণে যুক্তরাজ্যের রেস্টুরেন্ট ব্যবসা যখন হুমকির মুখে পড়েছিল তখনই এগিয়ে আসে সরকার। রেস্টুরেন্টে ভোজনরসিকদের সমাগম বাড়িয়ে এই ব্যবসাকে বাঁচিয়ে রাখতে ঘোষনা করে ‘ইট আউট টু হেল্প আউট’ স্কিম।
এর আওতায় আগস্ট মাস জুড়ে সোম থেকে বুধবার ক্রেতারা পেয়েছেন ৫০ শতাংশ ছাড় সুবিধা। জনপ্রতি এই ছাড় ছিল সর্বোচ্চ ১০ পাউন্ড পর্যন্ত। যা ভোজনরসিকদের রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছে দারুনভাবে। ক্রেতাদের এই সুবিধা নিতে হয়েছে রেস্টুরেন্টে গিয়ে। আর ব্যবসায়ীদের সে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। বিশেষ করে করোনা আতঙ্কে ঘরবন্দি হয়ে মানুষকে স্বাভাবিক আনতে এবং কারিশিল্পে প্রাণ ফিরিয়ে এইখাতে কর্মরতদের কর্মসংস্হান রক্ষায় এ স্কীমের ঘোষণা দেয় বরিস জনসন সরকার।
সরকার ঘোষিত ‘ইট আউট টু হেল্প আউট’ স্কিমের সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন রসনা বিলাসীরা। ফলে নির্ধারিত দিনগুলোতে ভোজনরসিকরা ভীড় করেছেন রেস্টুরেন্টে। আস্বাদন করেছে প্রিয় মেনুগুলোর স্বাদ। এই স্কিমের ফলে লাভবান হয়েছে সবপক্ষই। ভোজন রসিকেরা যেমন অর্ধেক মূল্যে রসনা বিলাসের সুযোগ পেয়েছেন, তেমনি দীর্ঘদিন পর রেস্টুরেন্ট কর্মীরা কাটিয়েছেন ব্যস্ত সময়। রেস্টুরেন্টের টেবিল বুকিং পেতে লাইনে দাঁড়িয়ে ক্রেতাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ঘন্টার পর ঘন্টা। আগে থেকে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যেমে আগাম বুকিং দিয়েও অপেক্ষা করতে হয়েছে কয়েক ঘন্টা। যুক্তরাজ্যে এমন দৃশ্য অভূতপূর্ব। সারাদেশে নান্দোজ, ম্যাকডোনাল্ডস সহ খ্যাতনামা অশিয়ান রেস্তোরাগুলোতে কর্মরতরা দম ফেলার ফুরসত পাননি।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনা পেনডেমিকের কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়া কারিশিল্প কিছুটা হলেও উপকৃত হয়েছে এই স্কিমের আওতায়। ব্যবসা হয়েছে অন্য সময়ের দ্বিগুন। প্রাণ ফিরেছে এই ব্যবসায়। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী ও রসনা বিলাসী উভয়পক্ষই চান অন্তত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করুক সরকার। সেটা হলে মুখ থুবড়ে পড়া কারিশিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াবে। বার্মিংহামের হ্যালসোয়েনে বাংলা লাউঞ্জের মালিক আজাদ মিয়া বলেন, ইংরেজরা পরিবার বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে পছন্দ করে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ রাখতে হয়েছে রেস্টুরেন্ট। সরকারি নির্দেশনা মেনে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার মাধ্যমে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে রেস্টুরেন্ট ওপেন করলে করোনা ভীতির কারণে ক্রেতা সমাগম হচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে ভোজনরসিকদের ঘরের বাইরে এনেছে ‘ইট আউট টু হেল্প আউট’ স্কিম। তিনি বলেন, আমি যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। পাশাপাশি সরকার স্কিমটির সময়সীমা বৃদ্ধি করবে- এমন প্রত্যাশা করি। সেটা হলে আমরা আমাদের রেস্টুরেন্টে ২২ জন কর্মীকে নিয়মিত কাজে ফেরাতে পারবো। বাংলা লাউঞ্জে স্ত্রীকে নিয়ে ডিনারে এসেছিলেন মিক স্মিথ। তিনি বলেন, ইট আউট টু হেল্প আউট স্কিম আমাদের অনেক উপকারে এসেছে। আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। ব্যবসায়ীরাও উপকৃত হয়েছেন। এই স্কিম আরো কিছুদিন অব্যাহত রাখলে সবার জন্য ভালো হয়।
উস্টারের মশলা লাউঞ্জের মালিক লোকমান চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখতে হয়েছে করোনার কারণে। ফলে এই ব্যবসা চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। এই সময় নানা প্রণোদনা দিয়ে ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় ছিল ‘ইট আউট টু হেল্প আউট’ স্কিম। স্কিম চলাকালে আমাদের ব্যবসা হয়েছে অন্য সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ। সরকার স্কিমটির সময়সীমা বাড়ালে সবাই উপকৃত হবে। মশলা লাউঞ্জে বাবা-মা ও বান্ধবীকে নিয়ে ডিনারে এসেছিলেন জেসি। তিনি বলেন, আমি স্কিমটির সুবিধা উপভোগ করেছি। এর মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতা দু’পক্ষেই লাভবান হয়েছেন। আমি মনে করি এই স্কিমের মেয়াদ বাড়ানো উচিত।
করোনার কারণে কারিশিল্পের পাশাপাশি এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যবসায়ীরাও হয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত। তবে ভিন্ন চিত্রও রয়েছে। করোনা কালে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে যুক্তরাজ্যের অন্যতম কুকার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সিলেট ওয়েল্ডিং। সিলেট ওয়েল্ডিংয়ের স্বত্বাধিকারী সিআইপি কয়ছর আহমেদ বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে বিপর্যস্ত হয়েছে কারিশিল্প। কিন্তু আমরা এই সময়টুকু কাটিয়েছি ভিন্ন পরিস্থিতিতে দারুণ ব্যস্ততায়। করোনাকালে রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ রাখতে হওয়ায় সরকার প্রণোদনা নিয়ে ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আর ব্যবসায়ীরা সে অলস সময়ে প্রতিষ্ঠানের কুকারসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির মেরামত এবং উন্নয়নের কাজ সেরে নিয়েছেন। ফলে নতুন কুকারের বিপুল চাহিদা তৈরি হয়েছিল। আমরা যুক্তরাজ্য ছাড়াও ইউরোপের নানা দেশ থেকে প্রচুর অর্ডার পেয়েছি। সেগুলো সরবরাহ করতে গিয়ে ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন বাড়াতে হয়েছে, কর্মীদের কাটাতে হয়েছে ব্যস্ত সময়।
পর্যটকনির্ভর শহর বোর্নেমাউথে দু’টি আফ্রিকান খাবারের রেস্তরাঁ চালান অ্যান্ডি লেনাক্স। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, ‘ইট আউট টু হেল্প আউট’ তাকে তার কিছু ক্ষতিপূরণ করতে সহায়তা করেছে। এই মুহূর্তে বাণিজ্যের রেকর্ড ব্রেকিং হয়েছে, যদিও এটা সাময়িক। তিনি বলেন, সোমবার, মঙ্গলবার ও বুধবার সম্ভবত যে ব্যবসা হয়েছে তা গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ। এদিকে রেস্তরাঁগুলোতে ডিসকাউন্ট ডাইনিং বাড়ায় সমপ্রতি প্রকাশিত ট্রেজারি পরিসংখ্যান অনুসারে প্রায় ৮৪,০০০ আউটলেট ৬৪৮ মিলিয়নেরও বেশি খাবারের বিল যুক্ত হয়েছে এই স্কিমের আওতায়। স্কাই নিউজ সোমবার প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নিজেরা ভর্তুকি দিয়ে লন্ডনের বরো মার্কেটের অ্যাপলবি; লন্ডনের প্রাচীনতম পোলিশ রেস্তরাঁ ডাকুইস; লন্ডনের স্প্যানিশ রেস্তরাঁ চেইন হোসে পিজারো; সাউথ ইংল্যান্ডের চেইন পাব উডহাউস; ম্যানচেস্টার ভিক্টোরিয়া স্টেশনের নিকটবর্তী মামুচিয়াম; ম্যানচেস্টারের রিফিউজ; ম্যানচেস্টারের পেরু পের্ডু; স্কটল্যান্ড সিগনেচার পাব গ্রুপ; ওয়ান্ডসওয়ার্থ রোডের পর্তুগিজ এবং ভূমধ্যসাগরীয় রেস্তোরাঁ ল্যান্ডসানিয়া; কোভেন্ট গার্ডেনের লেডি অব দ্য গ্রেপস; ইয়র্কশায়ারজুড়ে ট্রু নর্থ ব্রিউ কো; শ্রীলঙ্কার খাদ্য চেইন কোকোনাট চেরি; এডিনবার্গের ৫৬ নর্থ; ক্যামব্রিজের একটি স্কাইলাইন বার এবং রেস্তরাঁ; স্টাফর্ডশায়ারের বারবিকিউ রেস্তরাঁ হারলেস স্মোকহাউস; স্পেনীয় রেস্তরাঁ ব্রিন্ডিসা, মেফেয়ারের কম্পটিয়ার এবং রোকা; গাউচো সেপ্টেম্বরজুড়ে ছাড়টি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। টোবি কার্ভি; হারভেস্টার; স্টোনহাউস পিজা এন্ড ক্যারিভি এই সুবিধা দেবে ৯ই সেপ্টেম্বর ও ওয়েদার স্প্যানস ১১ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। বার্মিংহামের খ্যাতিমান শেফ অ্যান্ড্রু শেরিডানের নেতৃত্বে ক্রাফট ডাইনিং রুম বুধবার ও বৃহস্পতিবারে ডিসেম্বর ছাড় দেবে। এছাড়া বেলগ্রাভিয়ার টমাস কিউবিট পাব এবং পেগি পোর্শঞ্চ ক্যাফে উভয়ই সেপ্টেম্বরে দাম কমিয়ে দেবে। কার্ডিফের চেইন পাব ফিলহারমনিক সপ্তাহের শুরুতে ‘অভূতপূর্ব’ টেবিল বুকিংয়ের পরে অফারটি উন্মুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ম্যানেজার নিক নিউম্যান বলেন, যে প্রকল্পটি চালিয়ে যাওয়া তাদের একটি ব্যবসায়ের সিদ্ধান্ত ছিল। এটি ‘গ্রাহকদের ফিরে আসার জন্য আরো আত্মবিশ্বাস’ দেবে বলে তারা মনে করে।সুত্র-মানবজমিন