সীমাহীন দুর্ভোগে মৌলভীবাজারে আটকে পড়া প্রবাসীরা : শেষ হচ্ছে ভিসার মেয়াদ, দু’দফা টিকেট করেও যেতে পারছেন না
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ৩:৫১ অপরাহ্ণ
স্বপন দেব, নিজস্ব প্রতিবেদক:
মৌলভীবাজার জেলায় আটকে পড়া ৫-৬ হাজার মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। তাদের কারো ভিসার মেয়াদ, কারো টিকেটের মেয়াদ, আবার কারো একামার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে পড়ায় চরম সঙ্কটে পড়েছেন। অনেকে ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েছেন। এ সংকট থেকে বাঁচতে ও প্রবাসের কর্মস্থলে ফিরে যেতে রেমিটেন্স যোদ্ধারা সরকারের সহায়তা কামনা করেছেন।
প্রবাসীদের অভিযোগ, দু’দফা টিকেট করার পর বাতিল হয়ে যাওয়ায় আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা। প্রবাসের কর্মস্থলে ফিরে যেতে সরকারের সহায়তা দাবি করে ইতিপূর্বে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী বরাবরে আবেদনসহ স্থানীয়ভাবে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন।
দুবাই প্রবাসী পতনঊষার ইউনিয়নের বাসিন্দা আহমদ আলী বলেন, গত ১০ জানুয়ারি ২ মাসের জন্য দুবাই থেকে দেশে আসি। দু’মাস পর গত ১৯ মার্চ প্রবাসে ফেরত যাওয়ার জন্য ৩৮ হাজার টাকায় টিকিটও করি। পরে করোনা মহামারির জন্য টিকিট বাতিল হয়। দ্বিতীয় দফায় সিলেটে গিয়ে করোনা রিপোর্ট সংগ্রহ করে ৭৫ হাজার টাকা খরচ করে গত ১৯ আগষ্টের টিকিট করি। এরপর সে টিকিটও বাতিল হয়ে যায়।
আহমেদ আলী বলেন, দেশে আসার পর থেকে টাকা পয়সা সব শেষ হয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। তারপর বারবার খরচ করেও প্রবাসের কর্মস্থলে যেতে পারছি না। ৩ হাজার ৫শ’ টাকার করোনা রিপোর্ট সংগ্রহ করতে তিন দিনে সিলেটে আসা যাওয়া সবমিলিয়ে খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। তাছাড়া দুই দফা অনলাইনেও আবেদন করেছি। কোন কাজ হচ্ছে না। এখন নিঃস্ব হয়ে পড়ার উপক্রম হয়ে পড়ছি।
ওমান প্রবাসী সালেহ আহমদ বলেন, চিকিৎসার জন্য গত ৩১ মার্চ একমাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসি। এরপর করোনার কারণে আটকা পড়ি। পুনরায় ওমানের কর্মস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করেও যেতে পারছি না। অথচ ৩ সেপ্টেম্বর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে পড়ছে। পরিবার পরিজন নিয়ে কিভাবে চলবো তা ভেবে পাচ্ছি না। তিনি আরও বলেন, আমরা প্রবাসে ফেরত যেতে কিংবা সরকারী প্রণোদনা পেতে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসসহ বিভিন্ন স্থানে ধর্ণা দিয়েও কোন ধরণের সুরাহা পাচ্ছি না।
কাতার থেকে আসা শমশেরনগরের প্রবাসী এমলাক মিয়া বলেন, আমরাও জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোন সাড়া পাইনি। কুয়েত প্রবাসী অমর মাহমুদ আনসারী, দুবাই প্রবাসী আব্দুল হান্নান, জয়নাল আবেদীন, আনোয়ার খাঁন, ওমান প্রবাসী সোহেল আহমদ, কাতার প্রবাসী মতিউর রহমান, মালয়েশিয়া প্রবাসী মুকুল মিয়া সহ কয়েকজন প্রবাসীরা জানান, পরিবার-পরিজন ও সংসারের হাল ধরতে বিভিন্ন সময়ে কমলগঞ্জের বাসিন্দারা কাতার, আরব-আমিরাত, বাহরাইন, ওমান, কুয়েত, সোদিআরব, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক হিসেবে গমন করেন। দীর্ঘদিন ধরে উল্লেখিত দেশ সমুহে কাজ করে উপার্জিত আয়ের একটি বড় অংশ দেশে পাঠিয়ে পরিবার ও সংসারের ভরনপোষন চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে ছুটিতে এসে করোনা মহামারীর কারণে কমলগঞ্জ উপজেলার সহস্রাধিক প্রবাসীরা বর্তমানে নানা জটিলতায় প্রবাসের কর্মস্থল দেশ সমুহে ফিরে যেতে পারছেন না। কারো ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ, কারো টিকেটের মেয়াদ উত্তীর্ণ, কারো একামার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে পড়ছে। এই সময় পর্যন্ত প্রবাসীরা ব্যাপক ঋণগ্রস্থ হওয়ায় চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিনাতিপাত করছি। বিভিন্ন ট্র্যাভেলস এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করলেও তারা সঠিক কোন তথ্যাদি পাচ্ছেন না। ফিরত টিকেট থাকার পরও এসব প্রতিষ্ঠান প্রচুর টাকা দাবি করছে বলে অভিযোগ করেন।
একদিকে অর্থাভাব ও এনজিওসহ বিভিন্ন ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়ছেন। এনজিও ঋণ ও ব্যক্তিগত ঋণ ছাড়াও কর্মক্ষেত্রে চাকুরিচ্যুত এসব নানা দুশ্চিন্তায় আতঙ্কিতভাবে সন্তানাদি ও পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। দেশে থাকাকালীন সময়ে প্রবাসী পরিবার সমুহকে প্রণোদনা ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদানের দাবি জানান। এসব বিষয়ে ইতিপূর্বে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রীর কাছেও তারা লিখিত অভিযোগ করেন।
প্রবাসী সোহেল আহমদ বলেন, আমরা পরিবারের আট, দশ জন সদস্যের হাল ধরলেও আমাদের সমস্যা নিয়ে কাউকে বলতেও পারছি না, আবার সইতেও পারছি না। দেশে আটকাপড়া প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে মানবিক দিক বিবেচনা করে দেশে থাকাকালীন সময়ে প্রণোদনা ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদান এবং সরকারি উদ্যোগে প্রবাসে ফেরত যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান চেয়ে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
এদিকে গত ২৫ আগস্ট কমলগঞ্জে নবাগত মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান এর সাথে সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে মতবিনিময় সভায় প্রবাসীদের নানা সমস্যার কথা জেলা প্রশাসকের কাছে তুলে ধরেন ১নং রহিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমদ বদরুল।
এ ব্যাপারে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশেকুল হক বলেন, সরকার প্রবাসীদের প্রতি সবসময় আন্তরিক রয়েছেন। তাদের একটি লিখিত আবেদন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। তাছাড়া প্রবাসে যেতে আগ্রহীদের অনলাইনে আবেদন করতে বলা হয়েছে।
জেলা কর্মসংস্থান অফিস, মৌলভীবাজার এর সহকারী পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, বর্তমান সরকারের ২০১৮ সালের নির্বাচনী এজতেহার অনুযায়ী প্রতি উপজেলা থেকে বছরে এক হাজার মানুষকে দক্ষ করে গড়ে তুলে সঠিকভাবে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিকরণ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে প্রবাসী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। প্রবাসীরা লিখিত আবেদন করলে আর্থিক প্রণোদনা দেয়া হবে। এছাড়া সহজশর্তে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে প্রবাসীদের জন্য ব্যাংক ঋণের সুবিধা আছে। প্রবাসীদের একটি ফরম পুরণ করে উর্দ্বতন অফিসে প্রেরণ করা হচ্ছে।