দলই চা বাগানের শ্রমিকদের মানবেতর জীবন : চাল ভাজা, চা-পানি খেয়েই দিনাতিপাত
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ আগস্ট ২০২০, ৬:৫৪ অপরাহ্ণ
স্বপন দেব, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী ব্যক্তি মালিকানাধীন দলই চা বাগানের দীর্ঘ ২৭ দিন থেকে বন্ধ রয়েছে। চা বাগান বন্ধ ঘোষণার পর থেকে চা শ্রমিকদের চোখে অন্ধকার নেমে আসে। এখন এক মুঠো খাবার জোগাতেই হিমশিম অবস্থা তাদের। ”চাল ভাজা চা পানি” খেয়েই দিনানিপাত করছেন দলই চা বাগানের শ্রমিকরা।
দলই চা বাগানের ৯০ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত চা শ্রমিক বিশখা কুর্মী জানান, জীবন, যৌবন সবটাই চা বাগানের জন্য দিয়ে দিলাম। অথচ গত প্রায় চার সপ্তাহ যাবত তাকে উপোষ কাটাতে হয় বেশীরভাগ সময়। যা একবেলা খেতে পান তাতেও পাতলা ডাল ছাড়া কিছুই জোটে না। অসহায় এই চা শ্রমিক বলেন, এই বয়সে এমনেইতো খেতে পারি না। তিন বেলার খাবারের কথা তাও খেতে পাচ্ছি না। বাড়ির ছেলে মেয়েদের মুখের দিকে তাকালে কষ্ট হয়। চিন্তুায় রাতে ঘুম আসে না। চাল ভাজা ও লবন দিয়ে চা পানি খেয়েই দিনানিপাত করছি। ৪০ বছর বয়সি চা-শ্রমিক বাদল নায়েক বলেন, তিনিই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ঘরে ৫/৭টি খাবার মুখ, তার দিকে চেয়ে আছে। অবুঝ বাচ্চারা তার কোন বুঝ মানছে না। মাও বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার মতো কোন পথ খুঁজে পাচ্ছেন না।
বাকরুদ্ধ চা শ্রমিকরা জানান, গত ২৭ জুলাই ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা বাগানে কাজ করছিলেন। সন্ধ্যায় কোন কারণ ছাড়াই কর্তৃপক্ষ বাগান বন্ধের ঘোষণা দেয়। এ খবর যখন তারা শুনে। তখন তাদের চোখে অন্ধকার নেমে আসে। এখন একমুঠো খাবার জোগাতেই হিমশিম অবস্থা তাদের।
চা শ্রমিক নেতা সাবের মিয়া বলেন, একদিকে ২৭ দিন ধরে কাজ বঞ্চিত, অন্যদিকে করোনা ভাইরাসের মৃত্যুঝুঁকিতে আছেন এই বাগানের শ্রমিকগণ। অবিলম্বে এই বাগানের সংকট নিরসন করা না গেলে শত শত চা শ্রমিকের জীবন বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। অতিদ্রুত যদি সমাধান না হয় তাহলে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। চা শ্রমিক নমি কুর্মী বলেন, এই দুর্যোগের সময় আমরাতো কারো দয়া চাইছি না। আমরা আমাদের হক দাবী করছি।
যে সময়গুলোতে গরিব মানুষেদের উপকারে বড়লোকেরা এসে দাড়াচ্ছে ঠিক সেই সময় আমরা আমাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমরা বাঁচলে সবাই একসাথে বাঁচতে চাই।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেটের দানবীর আলহাজ্ব রাগীব আলী ‘দলই টি কোম্পানি লিমিটেডের’ নামে সরকারের কাছ থেকে ইজারা এনেছেন। এ বাগানে মোট ১০০০ শ্রমিক আছে তার ভিতর ৫৫০ জন স্থায়ী শ্রমিক আছেন। প্রত্যেক শ্রমিক দৈনিক ১০২ টাকা করে মজুরি পান।
দলই বাগান শ্রমিক পঞ্চায়েত কমিটির সম্পাদক সেতু রায় বলেন, শ্রমিকেরা এমনিতেই দৈনিক কম মজুরি পান। এখন কাজও নেই মজুরিও মিলছে না। অধিকাংশ শ্রমিকের ঘরে চাল-ডাল নেই। উপোস করে দিন কাটাতে হচ্ছে। বাগান কর্তৃপক্ষ অনিদিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে।’
এদিকে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের অন্তর্গত মনু-দলই ভ্যালি কার্যকরী পরিষদ ও মনু-দলই ভ্যালির সকল চা বাগান পঞ্চায়েত এর সিদ্ধান্ত মোতাবেক গত ২১ আগস্ট মনু-দলই ভ্যালির ১৩ চা বাগানের সেচ্ছায় প্রদত্ত অনুদান দলই চা বাগানের ৫৫০ টি পরিবার এর মাঝে জনপ্রতি ২৫০/ করে সহায়তা প্রদান করা হয়।
নোটিশের কথা উল্লেখ করে দলই চা বাগান ব্যবস্থাপক আমিনুল ইসলাম বলেন, গত বুধবার থেকে পুনরায় বাগানের শ্রমিকদের কাজ শুরু করার কথা ছিল। সেটি না করে দেওয়া তারা আইন (বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬, অদ্যবধি সংশোধিত, ১৩/১ ধারা) ভঙ্গ করে এজিএমসহ তিন জনকে মারধর ও বাগানে উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে। যে কারণে বাগানটি আবারও বন্ধ করা হলো। গত ২৮ জুলাই বন্ধের যে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল, সেটাও একই কারণে দেওয়া হয়েছিল। এ ঘটনায় বাগানের পক্ষ থেকে শনিবার কমলগঞ্জ থানায় ১৩ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরো ১০/১২ জনকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করা হয়।
কমলগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আরিফুর রহমান বলেন, দলই চা বাগান কোম্পানির এজিএম ও ব্যবস্থাপককে অবরুদ্ধ করা, জিপ গাড়ির কাচ ভাঙচুর এবং দুই নারী চা শ্রমিক লাঞ্চিতের ঘটনা ঘটেছে বলে তারা জেনেছেন। তবে এ বিষয়ে কমলগঞ্জ থানায় বাগান কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে গত শনিবার একটি মামলা হয়েছে।