বঙ্গবন্ধুর সিলেট সফর ও কিছু কথা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ আগস্ট ২০২০, ৬:৩০ অপরাহ্ণ
সৈয়দ মোহাম্মদ তাহের:
বাংলাদেশের মহান স্থপতি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক নানা প্রেক্ষাপটে বহুবার সিলেট এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী বহু সহযোদ্ধা ও ঘনিষ্ঠ সহচর রয়েছেন এই সিলেট বিভাগে। এই পুণ্যভূমিতে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের নানা চিত্রপটের ঐতিহাসিক সন্ধান পাওয়া যায়। সিলেটের প্রাকৃতিক বৈচিত্রের টানে নয়; বরং সহযোদ্ধাদের নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের নানা আন্দোলনকে ঘিরেই বঙ্গবন্ধু সিলেট সফর করেছিলেন।
১৯৪৭ র রেফারেন্ডামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন তরুণ ছাত্রনেতা। সিলেটের রেফারেন্ডাম খ্যাত গণভোটের পক্ষে প্রচারণায় তিনি প্রথম সদলবলে পাঁচশত নেতাকর্মী নিয়ে সিলেট আসেন। এই সম্পর্কে লেখক ও রাজনীতিবীদ সৈয়দ ইসলাহ উদ্দীন আহমদ রচিত দারিদ্র্য বিমোচনের সংগ্রাম গ্রন্থ হতে অংশ বিশেষ পাঠকের জন্য তোলে ধরা হল- “হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামছুল হক, সুলেমান, শাহ আজিজুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ সেকালের নামকরা শো খানেক ছাত্র নেতা এসেছিলেন। এদের আগমনে আমাদের ভয়ভীতি কেটে গেল। এদের আসার পূর্বে মনে হয়েছিল আমরা একা, আমাদের কেউ নেই, এখন দেখলাম আমরা একা নই আমরা একই বাঙালী পরিবারের সদস্য। এই ছাত্রনেতারা প্রত্যেকেই ছিলেন এক এক জন বিপিন পাল। এদের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় আগুন ঝরতো, মৃতদেহে প্রাণের সঞ্চার হতো। এই সময়েই শামছুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আমার (সৈয়দ ইসলাহ উদ্দীন আহমদ) পরিচয় ঘটে। গ্রন্থটিতে তিনি আরো লিখেছেন ‘১৯৬৪ সালে সিলেটের বালাগঞ্জ উপনির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আমার (সৈয়দ ইসলাহ উদ্দীন আহমদ) নির্বাচনী এলাকায় বালাগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ আসনটি একটি মুসলিম লীগ পরিবার দখল করে রেখেছিল। এই পরিবারের একজনকে একবার স্বাধীনতা যুদ্ধের কমান্ডার-ইন-চিফ এমএজি ওসমানীর পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান নির্বাচনে পরাজিত করতে পেরেছিলেন। এ ছাড়া এই পরিবারের প্রার্থীকে আর কেউ কখনো পরাজিত করতে পারে নাই। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা ছিল এই আসনটিকে মুসলিম লীগের দখলমুক্ত করবেন। মীরজাফর একসময় সিরাজদ্দৌলার খুব বিশ^স্ত ছিলেন। খোন্দকার মোশতাকও সেইরূপ বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ছিলেন। তাই খোন্দকার মোশতাক ও সরাইলের দেওয়ান মাহবুব আলীকে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জে একটি স্টাডি টিম প্রেরণ করেন। খোন্দকার মোশতাক ও দেওয়ান মাহবুব আলী সিলেট এসে আমার বাসায় অবস্থান করেন এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদক দেওয়ান ফরিদ গাজীকে নিয়ে একখানা উইলি জীপে করে তিনদিন ধরে বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জের সর্বত্র ঘুরেন। ঢাকায় গিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুকে আমার কথা বলেন এবং মনোনয়ন দানের সুপারিশ করেন। ১৯৬৪ সালের ১৭ মে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ সহ সকল বিরোধী দল অংশ গ্রহন করে। বস্তুত পূর্ববর্তী কয়েক বছরের আন্দোলনের ফলে উপ নির্বাচনটি সরকার ও বিরোধীদলগুলির মধ্যে শক্তি পরীক্ষার একটি ক্ষেত্র হিসাবে পরিগণিত হয়। ১৭ মে-র উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে দুইজন ও ভাসানী ন্যাপ থেকে একজন মোট তিনজন মনোনয়ন প্রার্থনা করেন। প্রত্যেক বিরোধীদল থেকে দ্ইুজন সদস্য নিয়ে নির্বাচনী প্রার্থী বাছাই এর জন্য পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করা হয়। কনভেশন মুসলিম লীগ অর্থাৎ সরকারী দল বিরোধীদলের মনোনয়ন দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। ইত্যবসরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সর্ব্চ্চো নেতাদের প্রায় বিশজনকে নিয়ে এসে হাজির হন। এদের মধ্যে মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ, তাজউদ্দিন আহমদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মালিক উকিল, মতিউর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ প্রমুখ সকলেই ছিলেন। এখন তাদের সকলের নাম মনে পড়ছে না।
বঙ্গবন্ধু আসার দুইদিন আগে থেকেই পার্লামেন্টারি বোর্ডের মিটিং চলছিল। জেলা বারের ২ নম্বর হলে বিকাল পাঁচটা থেকে শুরু করে অনেক রাত পর্যন্ত পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভা চলত। অনেক লোকের সমাগম হতো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছায় সৈয়দ ইসলাহ উদ্দীনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। পরের দিন সরকারী দল আমারই একজন শিক্ষক প্রাক্তন প্রফেসর আব্দুল মুনিম চৌধুরীকে মনোনয়ন দান করে। বঙ্গবন্ধু মিজানুর রহমান চৌধুরীকে ডেকে সকলের সামনে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করেন এবং নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত সিলেটে অবস্থান করতে বলেন। বঙ্গবন্ধুর কথা মতো মিজানুর রহমান চৌধুরী তেরো দিন নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছিলেন।
বিরোধী দলের উপনির্বাচনের পক্ষে নেতারা যে প্রচার পত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন সিলেটের তৎকালিন বিশিষ্ট রাজনীতিবীদ আব্দুল হাই এডভোকেট, শহীদ আলী এডভোকেট, হাবিবুর রহমান উকিল, মনির উদ্দিন আহমদ এডভোকেট, আমিনুল ইসলাম চৌধুরী উকিল, তফজ্জুল আলী, ইসমত আহমদ চৌধুরী উকিল, লুৎফুর রহমান, আব্দুল মুকিত উকিল, মওলানা রমিজ উদ্দিন, মইজ উদ্দিন আহমদ উকিল, ডা. আব্দুল মালিক, আব্দুল রহিম, আছদ্দর আলী, পীর হবিবুর রহমান, আব্দুল হামিদ, এ জেড আব্দুল্লাহ প্রমুখ।
গ্রন্থর লেখক আরো উল্লেখ করেন যে, “এই উপনির্বাচনের ফলে সম্মিলিত বিরোধীদল বুঝতে পারে যে, তাদের সম্মিলিত শক্তি সরকারি দলের শক্তি অপেক্ষা কম নয়। উপনির্বাচনের পর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে (সৈয়দ ইসলাহ উদ্দিন) নিয়ে সন্ধ্যার পর আওয়ামী লীগের পুরানা পল্টনের অফিসে ঢুকে ঘর ভর্তি সকলকে বলেন ‘আমরা ফেল করিনাই। বুঝতে পেরেছি, সরকারি হস্তক্ষেপ না হলে আমরা বিপুল ভোটে পাশ করে যেতাম।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সিলেট সফরে আসলে সবসময় হযরত শাহজালাল (র.) মাজার শরিফ জিয়ারত করতেন। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা ১৯৭০ সালে ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে সিলেটে সংক্ষিপ্ত সফরে এলে তাকে তৎকালীন মোতাওয়াল্লি সরেকওম এ জেড আব্দুল্লাহ অভ্যর্থনা জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে দরগা মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন এবং হযরত শাহজালাল (র.) মাজার জিয়ারত করেন। এই সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন-জননেতা আব্দুস সামাদ আজাদ, দেওয়ান ফরিদ গাজী, আবু নছর মনির বখত মজুমদার ও মুফতি আব্দুল কাদির ফারুক প্রমুখ।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দীর্ঘ নয় মাস পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ত্রিশলক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভের পর বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সিলেট সফরে একাধিকবার আসেন এবং হযরত শাহজালাল (র.) মাজার শরিফ জিয়ারত করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন উপমহাদেশের অদ্বিতীয় জননেতা। এই মহান সংগ্রামী রাষ্ট্রনায়কের জন্মশতবার্ষিকী মুজিব শতবর্ষতে তাঁর অম্লান স্মৃতির প্রতি আমাদের অপরিসীম শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র :
১. দারিদ্র্য বিমোচনের সংগ্রাম-সৈয়দ ইসলাহ উদ্দীন আহমদ
২. সিলেটে বঙ্গবন্ধু- সৈয়দ আব্দুল্লাহ
৩. ভাষা সংগ্রামীদের কথা- তাজুল মোহাম্মদ
(দৈনিক সিলেটের ডাক থেকে নেয়া)