সিলেটে জঙ্গি হামলা: ১৯ বছরে ৭ বার কেঁপে উঠেছে এই অঞ্চল
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ আগস্ট ২০২০, ১২:১৪ পূর্বাহ্ণ
মাহবুবুর রহমান রিপন ও ইয়াহইয়া মারুফ:
দেশে জঙ্গি তৎপরতার জন্য বারবার আলোচনায় এসেছে সিলেটের নাম। জঙ্গিদের হামলায় ১৯ বছরে ৭ বার কেঁপে উঠেছে এই অঞ্চল। এসব হামলায় নিহত হয়েছেন ২৬ জন, আহত হন ৪৩১ জন। এদের মধ্যে অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। এ ছাড়া আরও চারবার হামলার পরিকল্পনা করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় তা ভেস্তে যায়। দেশের শীর্ষ জঙ্গিদের অনেকে গ্রেফতারও হয়েছে সিলেট থেকে।
জঙ্গি নির্মূলে যারা কাজ করছেন তাদের মতে, সিলেট অঞ্চলের মানুষ ধার্মিক হওয়ায় নানা অপব্যাখ্যা দিয়ে তাদের দলে ভেড়াতে কাজ করছে জঙ্গিরা। অন্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেটে কড়া নজরদারিও রয়েছে বলে দাবি করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, এ অঞ্চলে বাড়তি নজরদারির কারণেই জঙ্গিদের সাম্প্রতিক পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে এবং নব্য জেএমবির আঞ্চলিক প্রধানসহ ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে।
জানা যায়, ২০০১-২০২০ পর্যন্ত ১৯ বছরে সিলেট অঞ্চলে ১১ বার হামলার পরিকল্পনা করে জঙ্গিরা। এর মধ্যে ৭ বারই সফল হয় তারা। রক্ত ঝরে সিলেটের মাটিতে। এসব ঘটনার বেশিরভাগই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। শুরুটা ছিল ২০০৪ সালের ১২ জানুয়ারি হজরত শাহজালাল (রহ.) দরগা শরিফে বোমা হামলা দিয়ে। এতে মারা যান ১০ জন এবং আহত হন ১৩৮ জন। একই বছরের ২১ মে একই স্থানে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে লক্ষ্য করে চালানো হয় বোমা হামলা। এতে হাইকমিশনার বেঁচে গেলেও মারা যায় অন্য দু’জন, আহত হন ২০ জন। এক মাসের মাথায় ২১ জুন দিরাই মধ্যবাজার জগন্নাথ জিউর মন্দির পয়েন্টে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উপস্থিতিতে জনসভা চলাকালে আরও একটি গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। এতে মারা যান ১ জন, আহত হন অর্ধশতাধিক। একই বছরের ৭ আগস্ট সিলেটের গুলশান সেন্টারে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলেই নিহত হন তৎকালীন নগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ইব্রাহিম আলী। আহত হন আওয়ামী লীগের ২০ নেতাকর্মী। এর প্রায় সাড়ে চার মাসের মাথায় ২৪ ডিসেম্বর মহিলা আওয়ামী লীগের সভায় গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন ৫ জন। ২০০৫ সালে ১ জানুয়ারি হবিগঞ্জের বৈধর বাজারে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা হামলায় মারা যান সাবেক অর্থমন্ত্রী গোলাম কিবরিয়াসহ পাঁচজন। আহত হন ১৫০ জন। সবশেষ ২০১৭ সালের ২৫ মার্চ দক্ষিণ সুরমার আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অপারেশন টোয়াইলাইট চলাকালে জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলায় ৭ জন নিহত হন, আহত হন ৫০ জন।
এই সময়ের মধ্যেই আরও ৪টি পরিকল্পনা ভেস্তে যায় জঙ্গিদের। ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও সিলেটে নির্বাচনী জনসভায় বোমা পেতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল হুজি-বি। কিন্তু হামলার আগেই জনসভাস্থলের অদূরে বোমা বিস্ফোরণে জঙ্গিদের দুই সদস্য নিহত হন। ২০০৫ সালে প্রয়াত বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের টিলাগড়ের একটি সভায় গ্রেনেড হামলা হলেও তা বিস্ফোরিত হয়নি। ২০০৬ সালে শীর্ষ জঙ্গি শায়খ আবদুর রহমান সিলেট অঞ্চলে বড় হামলার পরিকল্পনা করে নগরীর টিলাগড় এলাকায় আস্তানা গড়ে তোলেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেই তৎপরতা ভেস্তে দেয়। ২ মার্চ দলবলসহ আত্মসমর্পণ করেন তিনি। সবশেষ ২৩ জুলাই আবারও হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজারে বোমা হামলার পরিকল্পনা করে জঙ্গিরা। এ ঘটনায় ৫ জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এ অঞ্চলকে কেন জঙ্গিদের নিরাপদ বলে মনে হয়-এমন প্রশ্নে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, সিটিটিসি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন এতটাই তৎপর যে, কোনোভাবেই কোনো অঞ্চলকে নিরাপদ ভাবতে পারবে না জঙ্গিরা। তবে সিলেটকে টার্গেট করে ঘটনাপ্রবাহের কথা উল্লেখ করলে তিনি বলেন, এর বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে, বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের মানুষ ধর্মীয় অনুশাসনপ্রিয়। ফলে হয়তো ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে সহজেই দলে ভেড়াতে পারে তারা। এ ছাড়া এ পর্যন্ত আটক জঙ্গিদের মোটিভ দেখে মনে হয়েছে, তারা মাজারবিদ্বেষী। এটাও একটি কারণ হতে পারে।
তিনি বলেন, এ অঞ্চলের ওপর বাড়তি নজরদারিও আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। সে কারণেই ২৩ জুলাই মাজারে হামলা করতে পারেনি তারা। তাদের পরিকল্পনা আগেই জেনে গিয়েছিলাম আমরা। তবে তাদের আরও কোনো পরিকল্পনা ছিল কি না, তা গ্রেফতার হওয়া ৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যাবে। এ জন্য তাদের ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছিল। আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। সূত্র- যুগান্তর।