‘পানি আইলে কেউ চিনে না, ভোট আইলে পাও ধরি সালাম করে’
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জুলাই ২০২০, ১০:৪৩ অপরাহ্ণ
আবেদ মাহমুদ চৌধুরী:
সুনামগঞ্জের শহরের কয়েকটি এলাকায় পানি কমলেও হাওরাঞ্চলের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। জেলার ১১টি উপজেলাও ৪টি পৌরসভার কয়েক লাখ মানুষকে এখনো পানিবন্দি অবস্থায় চরম দুর্ভোগে রয়েছে।
আজ সোমবার (১৩ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ পৌর মেয়র নাদের বখত জানান, এখনো পৌর এলাকার অনেক বাড়ি, দোকান, সড়ক পানির নিচে রয়েছে। তাদের আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ ও শাল্লা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। দুই দিন ধরে জেলা সদরের সঙ্গে ৫টি উপজেলা বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, দোয়ারাবাজার ও ছাতকের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বানের পানিতে তলিয়ে গেছে উপজেলাগুলোর অভ্যন্তরীণ গ্রামীণ সংযোগ সড়কও।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ৪০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খোলা আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন প্রায় ৫শ’ মানুষ। তাদের শুকনো খাবার দেয়া হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বন্যায় রোপা আমনের ১৫১ হেক্টর বীজ তলা, ৩৫ হেক্টর গ্রীষ্মকালীন সবজি ও ৬৪১ হেক্টর আউশ ধান পানির নিচে প্লাবিত রয়েছে। তাহিরপুর উপজেলা সোহালা, গরেরঘাট বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। বানের পানিতে ভেসে গেছে ফাজিলপুর জামে মসজিদ। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বিন্নাকুলি বাজারে ৪টি দোকান। চানপুর-বাগলি সীমান্ত সড়ক যান চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার ৩৪৮৬টি পুকুরের মাছ ভেসে গিয়ে প্রায় ৩০কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এতে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ৯০৮জন খামারি। জনদুর্ভোগের পাশাপাশি গবাদি পশুদের নিয়ে আরও বেশি বিপাকে পড়েছেন মানুষ, সেই সঙ্গে গো-খাদ্যের সংকটে উদ্বিগ্ন কৃষকরা। নলকূপগুলো পানির নিচে তলিয়ে হওয়ায় বিশুদ্ধ খাবার পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এতে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের আশংকা রয়েছে।
হাওর পাড়ের গ্রামগুলোতে প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে বাড়ি ঘর হুমকির সম্মুখীন। ঘরগুলো কচুরিপানা দিয়ে রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জের ব্যবসায়ী আবু সালেহ জনি জানান, সুনামগঞ্জে দু-দফার বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবী মানুষরা। এমনিতেই করোনাভাইরাসের কারণে দোকানপাট খোলা নিষিদ্ধ থাকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়। তারপর যখন সীমিত পরিসরে ব্যবসা করার অনুমতি পাওয়া গেল সেই সময় দু-দফা বন্যায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা দারুণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মৎস্য খামারি মোশাররফ হোসেন জানান, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে খামার সম্প্রসারণ করেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে দু-দফা বন্যায় আমার খামারসহ অনেকের খামারের মাছ ভেসে গেছে। পোলট্রি খামারের শেড গুলোতে পানি ডুকায় অনেক হাস-মুরগী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করাতে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার নগর গ্রামের পাপ্পু কান্তি দাস জানান, আশ্রয় কেন্দ্রে লোকজন আসা লোকজন খাবার পেলেও বাসা-বাড়িতে আটকে থাকা পানিবন্দি পরিবার গুলো কোনধরনের সহায়তা পাচ্ছেন না। যার ফলে পানিবন্দি পরিবারগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
তাহিরপুর উপজেলার সংবাদকর্মী জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া জানান, তাহিরপুর উপজেলা বিভিন্ন রাস্তায় কয়েকটি জায়গায় ভাঙন হওয়ায় সুনামগঞ্জের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এতে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ কম থাকায় কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে ব্যবসায়ীরা। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ জনগণ।
গৌরারং ইউনিয়নের হোসেনপুর এলাকার বাসিন্দা সজল দাশ বলেন, ‘আমি মিলে কাজ করি। বন্যার পানি আইয়া আমার মিলে হাঁটু পানি। কাম-কাজ বন্ধ। আমরার কেউ এখনো খোঁজ-খবর নিছে না, আমরা ভালা আছি না মন্দ আছি। আমার ঘরের মেজো ভাইয়ের বাসার ভেতরে হাঁটু পানি। আমরা খুব কষ্টের মধ্যে আছি।’
একই গ্রামের বৃদ্ধা রফিকুন নেছা বলেন, ‘দুদিন ওই গেছে পানি উঠছে। ঘরের চুলাটাই পানির নিচে কিচ্ছু রানতে পারি না। ছেলে বাজারো গেছে চিড়া-মুড়ি কিনান। ছেলেটা আইলে পরে নাতিটারে লইয়া খাইমু। আমরারে কেউ এখন একমুঠ চিড়াও দিসে না। ঘরের মধ্যে পানি আর আজকে আরও বৃষ্টিতে পানিতো খাটো উঠি যাইবো। পরে ঘুমাইতেও পারতাম না।’
মনমতো চর গ্রামের বাসিন্দা আতিকুর রহমান বলেন, ‘আমার ৭০০ হাঁস আছিল। বন্যার পানিতে দুশর মতো হাঁস পানিত ভাসিয়া গেছে গি। এখন যা আছে এইগুলারেও কোনও রকমে রাখছি। নিজের ঘরেরই চুলা জ্বলে না দুদিন ধরি। হাঁস-গরুরে খাবার দিতাম কই থকি। আমাদের গ্রামে কেউ এখন কোনও সহযোগিতা করছে না, শুকনা খাবারও দিছে না।’
কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন হোসেনপুর গ্রামের ৭০ বছর বয়সী দিলার বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেটা মারা যাওয়ার পর থকি আমি ও আমার ছেলের বউ দিনমজুরের কাজ করি। কিন্তু এখন বন্যায় কোমর পানি। চারটা নাতি-নাতনি আমার। এরারে আমি ভাত দিতে পাররাম না। যদি পাশে বাড়ি থকি দেয় তাইলে আগে তারারে খাওয়াই। আমরা পানি আইলে আমরারে কেউ চিনে না, কিন্তু ভোট আইলে পাও ধরি সালাম করে।’
গৌরারং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফুল মিয়া বলেন, ‘আমি আমার ইউনিয়নের পানিবন্দি মানুষের কথা উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। তারা আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন, পর্যাপ্ত পরিমাণ শুকনা খাবার রয়েছে। এখন তারা আমাকে আমার ইউনিয়নের প্রয়োজন অনুযায়ী যদি বরাদ্দ দেন তাহলে আমরা খাবারগুলো পানিবন্দি মানুষের মধ্যে বিতরণ করবো।
পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বিপিএম জানান, বন্যার সময় যাতে চুরি, ডাকাতি না হয় সে জন্য ওসিদের সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল আহাদ জানান, ইতোমধ্যে ৩৪৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১৬ লাখ টাকা ও শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ত্রাণ বিতরণে সতর্ক থাকতে ইউএনও’দের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর পুরো বিষয়টি তিনি নিজে তদারকি করছেন। সূত্র- আরটিভি।