শ্রমিক নেতা খুনে সিলেটে উত্তেজনা : সড়ক অবরোধ, ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জুলাই ২০২০, ১২:১৫ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরু:
সিলেটে ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা ইকবাল আহমদ রিপন খুনের ঘটনায় টানা ১৫ ঘণ্টা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অবস্থান করে পরিবহন শ্রমিকরা। গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকে গতকাল বেলা সোয়া ২টা পর্যন্ত বৃষ্টি উপেক্ষা করে তারা বিক্ষোভ করে। এ সময় তাদের প্রধান দাবি ছিল- রিপনের খুনিদের গ্রেপ্তার করা। মহাসড়ক অবরোধকালে কয়েক কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে যানজট। পরে গতকাল দুপুরে প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের পর ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে তারা রাজপথ থেকে সরে এসেছে। এ ঘটনায় সিলেটের পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। সিলেট জেলা ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল আহমদ রিপন। বাড়ি সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমার খোজারখলা গ্রামে।
গত শুক্রবার রাত ১১টার দিকে রিপন যমুনা ওয়েল ডিপো সংলগ্ন তার দোকান বন্ধ করে সঙ্গে থাকা তার বন্ধু বাবলা মিয়াকে নিয়ে পিরোজপুর রোডস্থ পূর্ব খোজারখলাস্থ বাসায় ফিরছিলেন। বাবনা পয়েন্টে আসা মাত্র একদল সন্ত্রাসী তাদের ওপর হামলা করে। এ সময় সন্ত্রাসীরা তাকে ঘিরে ধরে উপর্যূপরি ছুরিকাঘাত করে। সঙ্গে থাকা বন্ধু বাবলা এগিয়ে এলে তার ওপরও হামলা করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় রিপন ও বাবলাকে মধ্যরাতে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে যাওয়া মাত্র কর্তব্যরত ডাক্তার রিপনকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্র সিলেটের ট্যাঙ্কলরি শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাতেই তারা প্রথমে বাবনা পয়েন্টে এবং পরে নগরীর প্রবেশমুখ চণ্ডিপুল ও হুমায়ূন রশীদ চত্বরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ সময় তারা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। কয়েকশ’ শ্রমিক রাতভর রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করার কারণে সিলেট নগরীতে প্রবেশের আগেই ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকা আসা যানবাহনগুলো নগরের প্রবেশমুখে আটকা পড়ে। যাত্রীরা হেঁটে সিলেট নগরীতে প্রবেশ করেন। এদিকে সকাল হতেই হাজারো শ্রমিক বিক্ষোভে নামে। তারা খুনিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে রাজপথ না ছাড়ার ঘোষণা দেন। শ্রমিকদের বিক্ষোভের কারণে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রশিদপুর এলাকা পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকায় যানজট দেখা দেয়। সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ ও সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কের যানবাহনও নগরে প্রবেশ করতে পারেনি। ভারী বর্ষণের মধ্যেও শ্রমিকরা রাজপথে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন অব্যাহত রাখে।
শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন- গত ২৭শে রমজান বাবনা পয়েন্টস্থ রেলওয়ের সাধুরবাজার সংলগ্ন যমুনা ওয়েল ডিপোর পাশে রয়েছে ট্যাঙ্কলরি সদস্য মো. ইউনুস মিয়ার তেল বিক্রির দোকান। তেলের লরি থেকে দ্বিতীয় দফা তেল বিক্রিকালে বরইকান্দি এলাকার এজাজুল, রিমু, মুন্নার নেতেৃত্বে ৭-৮ জন সন্ত্রাসী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রথমে টাকা দাবি করে। টাকা না দেয়ায় তারা ইউনুস মিয়া ও তার শ্রমিকদের ওপর হামলা চালায়। এক পর্যায়ে দোকানের ক্যাশে থাকা তেল বিক্রির প্রায় ৩ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় ইউনুস মিয়া বাদী হয়ে দক্ষিণ সুরমা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই ঘটনায় বিভাগীয় ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল আহমদ রিপন জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সিলেট বিভাগীয় ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. মনির হোসেন ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমির আলীসহ শ্রমিক নেতারা অভিযোগ করেন- ঘটনার জের ধরে বরইকান্দি এলাকার এজাজুল, রিমু, মুন্নার নেতৃত্বে ১০-১২ জন সন্ত্রাসী রিপনের ওপর হামলা করে। তাদের হামলা এবং ছুরিকাঘাতে মারা যান রিপন। ঘটনার পর এদেরকে আসামি করে শুক্রবার রাতেই দক্ষিণ সুরমা থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু সরকার জানিয়েছেন- রিপনের খুনিদের গ্রেপ্তার না করলে সিলেট বিভাগ জুড়ে কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। শ্রমিকদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি রুনু মিয়াসহ সংগঠনের নেতারা। তারা বলেন, এ ঘটনার প্রতিবাদে পরিবহন শ্রমিকরা কর্মসূচি পালনে একতাবদ্ধ ছিল। এবং আগামীতে থাকবেও। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) জ্যোর্তিময় সরকার জানিয়েছেন, শ্রমিক নেতা খুনের ঘটনায় পুলিশ এজাহার নামীয় এক আসামিসহ দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে- বরইকান্দি এলাকার নোমান আহমদ ও সাদ্দাম আমহদ। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করেছেন নিহতের স্ত্রী ফারজানা আক্তার। এদিকে উদ্ভূত ঘটনা নিয়ে গতকাল দুপুরে সিলেট বিভাগীয় ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। দুই ঘণ্টার বৈঠক শেষে তারা প্রশাসনের আশ্বাসে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে অবরোধ প্রত্যাহার করে নেন। এরপর শ্রমিকরা সরে গেলে সিলেটে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। বৈঠকে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন, পুলিশের ডিসি সোহেল আহমদ মিয়া, এসএমপি ট্রাফিক পুলিশের ডিসি ফয়সল মাহমুদ, দক্ষিণ সুরমা থানার এসি ইসমাঈল আহমদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন, বাংলাদেশ সিএনজি ওনার্স এসোসিয়েশন সিলেট বিভাগীয় কমিটির সভাপতি মো. জুবায়ের আহমাদ, বিভাগীয় ট্যাঙ্কলরি মালিক সমিতির সভাপতি মো. হুমায়ুন আহমদ, ২৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র তৌফিক বক্স লিপন, ২৫নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তাকবির ইসলাম পিন্টু প্রমুখ। সিলেট ভিাগীয় ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সকল দাবি পুলিশ প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কছে উপস্থাপন করেন সংগঠনের চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়া। নিহত রিপন নিয়ে সকল ঘটনা ও পুলিশের ভূমিকা এবং অভিযোগ তুলে ধরেন ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. মনির মিয়া। সভায় বাংলাদেশ ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক ফেডারেশন চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়া দাবি ও কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে রয়েছে- আজ সারা দেশে কর্ম বিরতি পালন ও শোক পালন করবে সকল শ্রমিকরা। আর সেই সঙ্গে কর্ম বিরতি চলবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সিলেট বিভাগের সকল ট্যাঙ্কলরি আজ রোববার ও আগামীকাল সোমবার কোনো তেলের ডিপো থেকে তেল উত্তোলন করবে না। সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখবে। আসামীদের গ্রেপ্তার পুলিশ প্রশাসনকে ৪৮ ঘণ্টার সময় দেয়া হয়েছে। যদি এই সময়ের মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করা না হয়, তাহলে ফেডারেশন সারা দেশে অবরোধসহ কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা দিবে। এর আগ থেকেই সিলেটে ফের সড়ক অবরোধ করে রাখা হবে। ৪৮ ঘন্টার ভিতর অখিযুক্ত দক্ষিণ সুরমা থানার অফিসার ইনচার্জ খাইরুল ফজল, সেকেন্ড অফিসার রিপন দাস, কদমতলী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ফয়েজকে প্রত্যাহার করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিহত রিপনের সঙ্গে আহত ব্যক্তি বাবলার সুচিকিৎসার দায়ভার পুলিশ প্রশাসনকে নিতে হবে। রেলওয়ে প্রকৌশলী আলী আকবরকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
এদিকে- বৈঠকে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি (দক্ষিন) সোহেল আহমদ দাবি পূরণের আশ্বাস দেন এবং শ্রমিকদের পাশে থেকে সকল কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। মামলার এজাহারে থাকা আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে বলে আশ্বস্থ করেন। এরপর শ্রমিকরা রাজপথ থেকে সরে আসে।