মালয়েশিয়ায় রায়হানের পাশে কি থাকবে বাংলাদেশ, হাইকমিশন ও প্রবাসীরা?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ জুলাই ২০২০, ১:২০ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক :
আল জাজিরায় প্রচারিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়ে তোলপাড় চলছে মালয়েশিয়ায়। লকডআপ ইন মালয়েশিয়ান লকডাউন-১০১ ইস্ট-শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে মালয়েশিয়ায় থাকা প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি লকডাউন চলাকালে দেশটির সরকারের নিপীড়নমূলক আচরণ উঠে এসেছে।
মালয়েশিয়ায় লেখাপড়া করতে যাওয়া রায়হান কবির নামের এক বাংলাদেশি এই নিপীড়নের প্রতিবাদ করেন।
মালেয়েশিয়ার বন্দিশালায় থাকা তার এক বন্ধুর খোঁজও নিতে যান তিনি। কিন্তু আলজাজিরার প্রতিবেদন দেখে এখন রায়হান কবিরকেও খুঁজছে মালয়েশিয়ার পুলিশ।
তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে। তাকে ধরিয়ে দিতে দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ ও পুলিশের আইজি গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন।
মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগ জানিয়েছে, রায়হান কবিরের সর্বশেষ অবস্থান কোথায় ছিল সেই তথ্য জানিয়ে তার সম্পর্কে তথ্য জানাতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বারনামার এক প্রতিবেদনে এসব কথা জানানো হয়েছে।
রায়হান কোনো অপরাধ করেননি। তিনি বৈধভাবে সেখান থাকছেন। অথচ এমনভাবে মালয়েশিয়া বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাকে খুঁজছে যেন সে বড় অপরাধী।
অবশ্য ক্ষোভের কারণটা শুধু রায়হান নয়। গত ৩ জুলাই আল-জাজিরার ইংরেজি অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর থেকে দেশটির স্থানীয় নাগরিকরাও সরব হয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মালয়েশিয়া সরকার মুভমেন্ট কনট্রোল অর্ডার (এমসিও) এর মাধ্যমে মহামারির সময়ে অভিবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। আল জাজিরার প্রতিবেদনে অভিবাসীদের প্রতি মালয়েশিয়ার নিপীড়েনের যে ছবি উঠে এসেছে সেটা তো কোনো সভ্যতার পরিচায়ক নয়। মালয়েশিয়া সবসময় এই অবস্থাটা লুকাতে চেয়েছে। আর তাই তারা এখন বলছে, দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী বিদেশি নাগরিকদের বৈধতা বাতিল করে বের করে দেওয়া হবে।
দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগের মহাপরিচালক খায়রুল দাজাইমি দাউদ গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে এই হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মালয়েশিয়ার ভাবমূর্তি নষ্ট করার লক্ষ্যে আল জাজিরায় যারা বিবৃতি দিয়েছেন সেটি সঠিক প্রমাণিত না হলে তাদের দেশ ত্যাগ করতে হবে। তিনি বলেছেন, মালয়েশিয়া থাকা সকল বিদেশি বিশেষত দীর্ঘমেয়াদি পাসধারী যেমন: স্টুডেন্ট পাস, অস্থায়ী কর্মসংস্থান পাস, আবাসিক পাস এবং অন্যদের বক্তব্য দেওয়ার সময় সাবধান হতে হবে।
অন্যদিকে আল জাজিরার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা তথ্য ভিত্তিহীন দাবি করে কাতারভিত্তিক টিভি চ্যানেলটিকে মালয়েশিয়া জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব।
আলজাজিরায় সেই প্রতিবেদনটিতে কী ছিল? সেখানে দেখানো হয়েছে কর্মহীন ও খাবার সংকটে থাকা অভিবাসী শ্রমিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তাদের ঘর থেকে টেনে-হিঁচড়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অভিবাসী নারীদের তাদের ছোট ছোট শিশুদের থেকে আলাদা করে মারধর করা হচ্ছে।
অভিবাসীদের প্রতি বিশেষত বাংলাদেশি অভিবাসীদের প্রতি মালয়েশিয়ার আচরণ বেশ হতাশাজনক। ১৬টি দেশের প্রায় ৩০ লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে দুরবস্থায় থাকেন বাংলাদেশিরা।
এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ মালয়েশিয়া। রাস্তার দুই পাশে আকাশছোঁয়া সব অট্টালিকা, অসংখ্য ফ্লাইওভার, প্রশস্ত সব সড়ক দেখে মুগ্ধ হতে হয়। দেশটিতে অধিকাংশ বাংলাদেশি শ্রমিকের দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে কর্মক্ষেত্রে। সকাল থেকে সন্ধ্যা, কখনো কখনো রাত পর্যন্ত তারা কাজ করেন। এরপর কারখানার পেছনে বস্তির মতো অন্ধকার কতগুলো খুপরি ঘরে রাত কাটান তারা। থাকার ঘরগুলো দেখলে মনে হবে, কোনো উদ্বাস্তু শিবির কিংবা বন্দিশালার প্রকোষ্ঠ। আর যারা অনিয়মিত বা কাগজপত্র নেই তাদের তো আতঙ্কের শেষ নেই।
যতবার মালয়েশিয়ায় কাজ করতে গিয়েছি সবসময় শুনতে হয়েছে বিপুল সংখ্যক লোকের কাগেজপত্র ঠিক নেই। এর একটা বড় কারণ নিয়োগকর্তারা সেগুলো যথাসময়ে করে না। আবার অনেকে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে থাকেন। ফলে এই বাংলাদেশিদের সবসময় পুলিশের ভয়ে থাকতে হয়। মালয়েশিয়ার অভিবাসন পুলিশ যখন তখন বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায়। যাকে-তাকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের ভয়ে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে অনেকের হাত-পাও ভেঙেছে।
মালয়েশিয়া প্রবাসীদের কাছে ভয়াবহ আতঙ্কের নাম রতান (বেত মারা)। গা শিউরে ওঠে রতানের বর্ণনা শুনে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘এ ব্লো টু হিউম্যানিটি: টর্চার বাই জুডিশিয়াল ক্যানিং ইন মালয়েশিয়া’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে বলেছে, ক্যাম্প বা কারাগারে ৫০ থেকে ৬০ জনকে একসঙ্গে রেখে মধ্যযুগীয় কায়দার বেত মারা হয়। চার ফুট লম্বা ও এক ইঞ্চি মোটা এই বেতের প্রচণ্ড এক আঘাতেই অধিকাংশ মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়। শরীরের চামড়া কেটে যায়, রক্ত জমাট বেঁধে যায়। জ্ঞান ফেরে ১২ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর। অসংখ্য বাংলাদেশি এই নির্যাতনের শিকার।
মালয়েশিয়ার মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, বাংলাদেশিদের অন্যায়ভাবে এই বেত মারা হচ্ছে। খুন, ধর্ষণসহ মোট ৬৬ ধরনের অপরাধের শাস্তি হিসেবে বেত মারা হয়। ভিসার মেয়াদ শেষ হলে বা অতিরিক্ত সময় থাকার কারণে বেত মারা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে সেটা মানা হয় না।
অভিবাসীদের কীভাবে অসম্মান করা হয় আল জাজিরার প্রতিবেদনে তা দেখানো হয়েছে। এই যে গরু-ছাগলের মতো লোকজনকে টেনে নেওয়া সেটা কিন্তু নতুন নয়। ২০১৫ সালে আমার চোখের সামনেই এই ঘটনা ঘটেছে। মনে আছে, দেশে পাঠানোর জন্য কুয়ালালামপুরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনের ফুটপাতে ৯৪ বাংলাদেশিকে খালি পায়ে গেঞ্জি পরিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছিল ঢাকা পাঠানোর জন্য। তাদের সবার হাতে ছিল শিকল।
পরপর দুদিন এমন ঘটনা দেখি। শুধু ফুটপাতে নয়, পরদিন গেঞ্জি-লুঙ্গি পরা মানুষগুলোকে দেখি খালি পায়ে হাত শিকল বেঁধে এমনভাবে নেওয়া হচ্ছে। বিমানবন্দরে নানা দেশের মানুষ সেদিন বিস্ময় নিয়ে এই বাংলাদেশিদের দেখছিলেন। অভিবাসনের কোনো আইনেই এভাবে শিকল পরানোর নিয়ম নেই। কিন্তু বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা এ নিয়ে কোনো কথা বলেননি। গণমাধ্যমে ছবি ও প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিমানবন্দরে শিকল পরানো বন্ধ হয়।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বন্দিশিবিরগুলোর চিত্র কিছুটা দেখানো হয়েছে। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বন্দিশিবির ও কারাগারে সবসময় এক দেড় হাজার বাংলাদেশি থাকে। এদের বেশির ভাগই অবৈধভাবে অবস্থানের কারণে গ্রেপ্তার হন। গত এক দশকে অন্তত এক লাখ বাংলাদেশি এই বন্দিশিবিরে ছিলেন। সাজা খেটে দেশে ফেরা বাংলাদেশিরা প্রায়ই অভিযোগ করেন, ক্যাম্পগুলোতে বাংলাদেশিদের ওপর নির্যাতন করা হয়। ক্যাম্পে অনেক বাংলাদেশি মারা যান। এবার যেমন সেখানে করোনা ছড়িয়েছে।
মালয়েশিয়ায় থাকা যে কোনো বোধসম্পন্ন বাংলাদেশি এসবের প্রতিবাদ করবে। রায়হান কবির আল জাজিরায় সেভাবেই প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু এখন তাকে ধরার জন্য মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ উঠে পড়ে লেগেছে। আল জাজিরা থেকে ছবি নিয়ে মালয়েশিয়ার গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুলিশ বলছে তার খোঁজ দিতে। তাকে যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করা হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রায়হান এবং দেশে থাকা তার অসুস্থ মা, বাবাসহ সবাই এখন দুশ্চিন্তায় আছেন। তারা বলছেন, রায়হান তো কোনো অপরাধ করেনি। কেন তাহলে তাকে গ্রেপ্তারের জন্য পরোয়ানা জারি করা হবে?
মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিরা বলছেন, রায়হান কবির তো দাগী অপরাধী নন। তিনি শুধু টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তিনি যা দেখেছেন সাক্ষাতকারে সেটাই বলেছেন। তাহলে তাকে কেন গ্রেপ্তার করা হবে? কেন দাগী আসামির মতো ছবি প্রকাশ করে তাকে খুঁজতে হবে। এটা পুরো বাংলাদেশের অপমান। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘটনার প্রতিবাদ করছেন। আমি মনে করি শুধু সাধারণ প্রবাসী নয়, মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস, ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সব প্রবাসী এবং পুরো বাংলাদেশের রায়হানের পাশে থাকা উচিত।
শরিফুল হাসান: বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান